পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\S)Ny Vo রবীন্দ্র-রচনাবলী আশার পক্ষে ভারি কঠিন হইয়া উঠিল। আশার স্বামী ছাদের উপরকার শূন্য ঘরের কোণে বসিয়া আক্ৰোশে ছটফট করিতেছে, ইহা কল্পনা করিয়া বিনোদিনী মনে মনে তীব্ৰ কঠিন হাসি হাসিত। আশা উদবিগ্ন হইয়া বলিত, “এবার যাই ভাই চােখের বালি, তিনি আবার রাগ করিবেন।” বিনোদিনী তাড়াতাড়ি বলিত, “রোসো, এইটুকু শেষ করিয়া যাও। আর বেশি দেরি হইবে না।” খানিক বাদে আশা আবার ছটফট করিয়া বলিয়া উঠিত, “না ভাই, এবার তিনি সত্যসত্যই রাগ করিবেন- আমাকে ছাড়ো, আমি যাই।” বিনোদিনী বলিত, “আহা, একটু রাগ করিলই বা । সোহাগের সঙ্গে রাগ না মিশিলে ভালোবাসার স্বাদ থাকে না- তরকারিতে লঙ্কামরিচের মতো।” কিন্তু লঙ্কামরিচের স্বাদটা যে কী, তাহা বিনোদিনীই বুঝিতেছিল- কেবল সঙ্গে তাহার তরকারি ছিল না। তাহার শিরায় শিরায় যেন আগুন ধরিয়া গেল। সে যে দিকে চায়, তাহার চোখে যেন স্মৃলিঙ্গবর্ষণ হইতে থাকে। ‘এমন সুখের ঘরকন্না— এমন সোহাগের স্বামী। এ ঘরকে যে আমি রাজার রাজত্ব, এ স্বামীকে যে আমি পায়ের দাস করিয়া রাখিতে পারিতাম। তখন কি এ ঘরের এই দশা, এ মানুষের এই ছিরি থাকিত। আমার জায়গায় কিনা এই কচি খুকি, এই খেলার পুতুল!’ ( আশার গলা জড়াইয়া ) “ভাই চোখের বালি, বলো-না ভাই, কাল তোমাদের কী কথা হইল ভাই। আমি তোমাকে যাহা শিখাইয়া দিয়াছিলাম তাহা বলিয়াছিলে ? তোমাদের ভালোবাসার কথা শুনিলে আমার ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকে না ভাই ।” ܓ ܠ মহেন্দ্র একদিন বিরক্ত হইয়া তাহার মাকে ডাকিয়া কহিল, “এ কি ভালো হইতেছে ? পরের ঘরের যুবতী বিধবাকে আনিয়া একটা দায় ঘাড়ে করিবার দরকার কী। আমার তো ইহাতে মত নাই— কী জানি কখন কী সংকট ঘটিতে পারে।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ও যে আমাদের বিপিনের বউ, উহাকে আমি তো পর মনে করি না।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “না। মা, ভালো হইতেছে না। আমার মতে উহাকে রাখা উচিত হয় না।” রাজলক্ষ্মী বেশ জানিতেন, মহেন্দ্রের মত অগ্রাহ্য করা সহজ নহে। তিনি বিহারীকে ডাকিয়া কহিলেন, “ও বেহারি, তুই একবার মহিনকে বুঝাইয়া বল। বিপিনের বউ আছে বলিয়াই এই বৃদ্ধ বয়সে আমি একটু বিশ্রাম করিতে পাই। পর হউক, যা হউক, আপনি লোকের কােছ হইতে এমন সেবা তো কখনো পাই নাই।” বিহারী রাজলক্ষ্মীকে কোনো উত্তর না করিয়া মহেন্দ্রের কাছে গোল— কহিল, “মহিনদা, বিনোদিনীর কথা কিছু ভাবিতেছ?” মহেন্দ্ৰ হাসিয়া কহিল, “ভাবিয়া রাত্রে ঘুম হয় না। তোমার বোঠানকে জিজ্ঞাসা করে।া-না, আজকাল বিনোদিনীর ধ্যানে আমার আর-সকল ধ্যানই ভঙ্গ হইয়াছে।” আশা ঘোমটার ভিতর হইতে মহেন্দ্ৰকে নীরবে তর্জন করিল। বিহারী কহিল, “বল কী। দ্বিতীয় বিষবৃক্ষ !” মহেন্দ্ৰ। ঠিক তাই। এখন উহাকে বিদায় করিবার জন্য চুনি ছটফট করিতেছে। ঘোমটার ভিতর হইতে আশার দুই চক্ষু আবার ভৎসনা বর্ষণ করিল। বিহারী কহিল, “বিদায় করিলেও ফিরিতে কতক্ষণ। বিধবার বিবাহ দিয়া দাও- বিষদাত একেবারে ভাঙিবে ।” মহেন্দ্র। কুন্দরও তো বিবাহ দেওয়া হইয়াছিল। বিহারী কহিল, “থাক, ও উপমাটা এখন রাখো। বিনোদিনীর কথা আমি মাঝে মাঝে ভাবি। তোমার এখানে উনি তো চিরদিন থাকতে পারেন না। তাহার পরে, যে বন দেখিয়া আসিয়াছি সেখানে