পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Obr রবীন্দ্র-রচনাবলী বিনোদিনী ও আশা গাড়িতে প্ৰবেশ করিল। বিহারীকে লইয়া কী করিবে, মহেন্দ্ৰ তাই ভাবিয়া একটু ইতস্তত করিতে লাগিল। বিহারী বোঝাটা গাড়ির মাথায় তুলিয়া দিয়া চট করিয়া কোচাবাক্সে চড়িয়া বসিল। মহেন্দ্ৰ হাফ ছাড়িয়া বাচিল। সে ভাবিতেছিল, “বিহারী ভিতরেই বসে কি কী করে, তাহার ঠিক নাই।” বিনোদিনী ব্যস্ত হইয়া বলিতে লাগিল, “বিহারীবাবু, পড়িয়া যাবেন না তো ?” বিহারী শুনিতে পাইয়া কহিল, “ভয় করিবেন না, পতন ও মূৰ্ছা-ওটা আমার পাটের মধ্যে নাই।” গাড়ি চলিতেই মহেন্দ্ৰ কহিল, “আমিই নাহয় উপরে গিয়া বসি, বিহারীকে ভিতরে পাঠাইয়া दि।” আশা ব্যস্ত হইয়া তাহার চাদর চাপিয়া কহিল, “না, তুমি যাইতে পরিবে না।” বিনোদিনী কহিল, “আপনার অভ্যাস নাই, কাজ কী, যদি পড়িয়া যান।” মহেন্দ্ৰ উত্তেজিত হইয়া কহিল, “পডিয়া যাব ? কখনো না।” বলিয়া তখনই বাহির হইতে উদ্যত হইল । বিনোদিনী কহিল, “আপনি বিহারীবাবুকে দোষ দেন, কিন্তু আপনিই তো হাঙ্গাম বাধাইতে অদ্বিতীয় ।” মহেন্দ্ৰ মুখ ভার করিয়া কহিল, “আচ্ছা, এক কাজ করা যাক। আমি একটা আলাদা গাড়ি ভাড়া করিয়া যাই, বিহারী ভিতরে আসিয়া বসুক।” আশা কহিল, “তা যদি হয়, তবে আমিও তোমার সঙ্গে যাইব ।” বিনোদিনী কহিল, “আর আমি বুঝি গাড়ি হইতে লাফাইয়া পড়িব ?” এমনি গোলমাল করিয়া কথাটা থামিয়া গেল । মহেন্দ্র সমস্ত পথ মুখ অত্যন্ত গম্ভীর করিয়া রহিল। দমদমের বাগানে গাড়ি পৌছিল। চাকরীদের গাড়ি অনেক আগে ছাড়িয়াছিল, কিন্তু এখনো তাহার খোজ নাই । শরৎকালের প্রাতঃকাল অতি মধুর। রৌদ্র উঠিয়া শিশির মরিয়া গেছে, কিন্তু গাছপালা নির্মল আলোকে ঝলমল করিতেছে। প্রাচীরের গায়ে শেফালিগাছের সারি রহিয়াছে, তলদেশ ফুলে। আচ্ছন্ন এবং গন্ধে আমোদিত । আশা কলিকাতার ইষ্টকবন্ধন হইতে বাগানের মধ্যে ছাড়া পাইয়া বন্যমূগীর মতো উল্লসিত হইয়া উঠিল। সে বিনোদিনীকে লইয়া রাশীকৃত ফুল কুড়াইল, গাছ হইতে পাকা আতা পাডিয়া আতাগাছের তলায় বসিয়া খালৈ, দুই সখীতে দিঘির জলে পড়িয়া দীর্ঘকাল ধরিয়া স্নান করিল। এই দুই নারীতে মিলিয়া একটি নিরর্থক আনন্দে— গাছের ছায়া এবং শাখাচ্যুত আলোক, দিঘির জল এবং নিকুঞ্জের পুষ্পপল্লবকে পুলকিত সচেতন করিয়া তুলিল। স্নানের পর দুই সখী আসিয়া দেখিল, চাকরদের গাড়ি তখনো আসিয়া পৌঁছে নাই। মহেন্দ্ৰ বাড়ির বারান্দায় চৌকি লইয়া অত্যন্ত শুষ্কমুখে একটা বিলাতি দোকানের বিজ্ঞাপন পড়িতেছে। বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারীবাবু কোথায়!” মহেন্দ্ৰ সংক্ষেপে উত্তর করিল, “জানি না।” বিনোদিনী । চলুন, তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করি গে। মহেন্দ্র। তাহাকে কেহ চুরি করিয়া লইবে, এমন আশঙ্কা নাই। না খুজিলেও পাওয়া যাইবে। বিনোদিনী । কিন্তু তিনি হয়তো আপনার জন্য ভাবিয়া মরিতেছেন, পাছে দুর্লভ রত্ন খোওয়া যায়। তাহাকে সাস্তুনা দিয়া আসা যাক । জলাশয়ের ধারে প্রকাণ্ড একটা বাধানো বটগাছ আছে, সেইখানে বিহারী তাহার প্যাকবাক্স খুলিয়া একটি কেরোসিন-চুলা বাহির করিয়া জল গরম করিতেছে। সকলে আসিবামাত্ৰ আতিথ্য করিয়া বাধা