পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8>br রবীন্দ্র-রচনাবলী দিয়া ভক্তের আর গতি নাই। তাই আজিও এই দু-ছত্ৰ চিঠি লিখিলাম— হে আমার পাষাণ-ঠাকুর, তুমি অবিচলিত হইয়া থাকে।”— মহেন্দ্র আবার চিঠির উত্তর লিখিতে প্ৰবৃত্ত হইল। কিন্তু আশাকে লিখিতে গিয়া বিনোদিনীর উত্তর কলমের মুখে আপনি আসিয়া পড়ে। ঢাকিয়া লুকাইয়া কৌশল করিয়া লিখিতে পারে না। অনেকগুলি ছিড়িয়া রাত্রের অনেক প্রহর কাটাইয়া একটা যদি বা লিখিল, সেটা লেফাফায় পুরিয়া উপরে আশার নাম লিখিবার সময় হঠাৎ তাহার পিঠে যেন কাহার চাবুক পড়িল— কে যেন বলিল, “পাষণ্ড, বিশ্বস্ত বালিকার প্রতি এমনি করিয়া প্রতারণা ?” চিঠি মহেন্দ্ৰ সহস্র টুকরা করিয়া ছিড়িয়া ফেলিল, এবং বাকি বুকুট টেবিলের উপর দুই হাতের মধ্যে মুখ চাকিয়া নিজেকে যেন নিজের দৃষ্টি হইতে লুকাইবার চেষ্ট রল | তৃতীয় পত্র- “যে একেবারেই অভিমান করিতে জানে না, সে কি ভালোবাসে। নিজের ভালোবাসাকে যদি অনাদর-অপমান হইতে বাচাইয়া রাখিতে না পারি, তবে সে ভালোবাসা তোমাকে দিব কেমন করিয়া । “তোমার মন হয়তো ঠিক বুঝি নাই, তাই এত সাহস করিয়াছি। তাই যখন ত্যাগ করিয়া গেলে, তখনো নিজে অগ্রসর হইয়া চিঠি লিখিয়াছি; যখন চুপ করিয়া ছিলে, তখনো মনের কথা বলিয়া ফেলিয়াছি। কিন্তু তোমাকে যদি ভুল করিয়া থাকি, সে কি আমারই দোষ। একবার শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত সব কথা মনে করিয়া দেখো দেখি, যাহা বুঝিয়াছিলাম, সে কি তুমিই বোঝাও নাই। * সে যাই হােক, ভুল হােক সত্য হােক, যাহা লিখিয়াছি সে আর মুছিবে না, যাহা দিয়াছি সে আর ফিরাইতে পারিব না, এই আক্ষেপ। ছি ছি, এমন লজাও নারীর ভাগ্যে ঘটে। কিন্তু তাই বলিয়া মনে করিয়ো না, ভালো যে বাসে সে নিজের ভালোবাসাকে বরাবর অপদস্থ করিতে পারে। যদি আমার চিঠি না চাও তো থাক, যদি উত্তর না লিখিবে তবে এই পর্যন্ত —” ইহার পর মহেন্দ্ৰ আর থাকিতে পারিল না। মনে করিল, “অত্যন্ত রাগ করিয়াই ঘরে ফিরিয়া যাইতেছি। বিনোদিনী মনে করে, তাহাকে ভুলিবার জন্যই ঘর ছাড়িয়া পালাইয়াছি! বিনোদিনীর সেই সম্পন্ধাকে হাতে হাতে অপ্ৰমাণ করিবার জন্যই তখনই মহেন্দ্র ঘরে ফিরিবার সংকল্প করিল। এমন সময় বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। বিহারীকে দেখিবামাত্ৰ মহেন্দ্রের ভিতরের পুলক যেন দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠিল। ইতিপূর্বে নানা সন্দেহে ভিতরে ভিতরে বিহারীর প্রতি তাহার ঈর্ষা জন্মিতেছিল। উভয়ের বন্ধুত্ব ক্লিষ্ট হইয়া উঠিতেছিল। পত্রপাঠের পর আজ সমস্ত ঈর্ষাভাৱ বিসর্জন দিয়া বিহারীকে সে অতিরিক্ত আবেগের সহিত আহবান করিয়া লইল । চৌকি হইতে উঠিয়া, বিহারীর পিঠে চাপড় মারিয়া, তাহার হাত ধরিয়া, তাহাকে একটা কেদারার উপরে টানিয়া বসাইয়া দিল । কিন্তু বিহারীর মুখ আজ বিমর্ষ। মহেন্দ্ৰ ভাবিল, বেচারা নিশ্চয় ইতিমধ্যে বিনোদিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়াছে এবং সেখান হইতে ধাক্কা খাইয়া আসিয়াছে। মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারী, এর মধ্যে আমাদের ওখানে গিয়াছিলে ?” বিহারী গম্ভীর্যমুখে কহিল, “এখনই সেখান হইতে আসিতেছি।” মহেন্দ্ৰ বিহারীর বেদনা কল্পনা করিয়া মনে মনে একটু কৌতুকবোধ করিল। মনে মনে কহিল, ‘হতভাগ্য বিহারী। স্ত্রীলোকের ভালোবাসা হইতে বেচারা একেবারে বঞ্চিত |’ বলিয়া নিজের বুকের পকেটের কাছটায় একবার হাত দিয়া চাপ দিল- ভিতর হইতে তিনটে চিঠি খড়খাড় করিয়া উঠিল । মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “সবাইকে কেমন দেখিলে ?” বিহারী তাহার উত্তর না করিয়া কহিল, “বাড়ি ছাড়িয়া তুমি যে এখানে ?” মহেন্দ্ৰ কহিল, “আজকাল প্ৰায় নাইট-ডিউটি পড়ে— বাড়িতে অসুবিধা হয়।” বিহারী কহিল, “এর আগেও তো নাইট-ডিউটি পড়িয়াছে, কিন্তু তোমাকে তো বাড়ি ছাড়িতে দেখি নাই।” মহেন্দ্ৰ হাসিয়া কহিল, “মনে কোনো সন্দেহ জন্মিয়াছে নাকি ৷”