পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 どこ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী যে কথা বলিবার নহে, সে কথা বলিয়ো না, তোমার কাছে আমার এই একান্ত মিনতি।” বিনোদিনী। ঠাকুরপো, কোথায় তোমার ব্যথা লাগিতেছে তাহা আমি জানি- কিন্তু যাহার শ্রদ্ধা আমি পাইয়াছিলাম এবং যাহার ভালোবাসা পাইলে আমার জীবন সার্থক হইত, তাহার কাছে এই রাত্রে ভয়-লজা সমস্ত বিসর্জন দিয়া ছুটিয়া আসিলাম, সে যে কতবড়ো বেদনায় তাহা মনে করিয়া একটু ধৈর্য ধরো। আমি সত্যই বলিতেছি, তুমি যদি আশাকে ভালো না বাসিতে, তবে আমার দ্বারা আশার আজি এমন সর্বনাশ হইত না । বিহারী বিবৰ্ণ হইয়া কহিল, “আশার কী হইয়াছে। তুমি তাহার কী করিয়ােছ।” বিনোদিনী । মহেন্দ্ৰ তাহার সমস্ত সংসার পরিত্যাগ করিয়া কাল আমাকে লইয়া চলিয়া যাইতে প্ৰস্তুত হইয়াছে। বিহারী হঠাৎ গর্জন করিয়া উঠিল, “এ কিছুতেই হইতে পারে না। কোনোমতেই না।” বিনোদিনী । কোনোমতেই না ? মহেন্দ্ৰকে আজ কে ঠেকাইতে পারে। বিহারী। তুমি পাের। বিনোদিনী খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল—তাহার পরে বিহারীর মুখের দিকে দুই চক্ষু স্থির রাখিয়া কহিল, “ঠেকাইব কাহার জন্য। তোমার আশার জন্য ? আমার নিজের সুখদুঃখ কিছুই নাই ? তোমার আশার ভালো হউক, মহেন্দ্রের সংসারের ভালো হউক, এই বলিয়া ইহকালে আমার সকল দাবি মুছিয়া ফেলিব, এত ভালো আমি নই— ধর্মশাস্ত্রের পুঁথি এত করিয়া আমি পড়ি নাই। আমি যাহা ছাড়িব তাহার বদলে আমি কী পাইব ।” বিহারীর মুখের ভাব ক্রমশ অত্যন্ত কঠিন হইয়া আসিল— কহিল, “তুমি অনেক স্পষ্ট কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছ, এবার আমিও একটা স্পষ্ট কথা বলি। তুমি আজ যে কাণ্ডটা করিলে, এবং যে কথাগুলা বলিতেছ, ইহার অধিকাংশই, তুমি যে-সাহিত্য পড়িয়াছ তাহা হইতে চুরি। ইহার বারো-আনাই নাটক এবং নভেল ।” বিনোদিনী । নাটক ! নভেল ! বিহারী। ইহা নাটক, নভেল। তাও খুব উচুদরের নয়। তুমি মনে করিতেছ, এ-সমস্ত তোমার নিজের— তাহা নহে। এ-সবই ছাপাখানার প্রতিধ্বনি। যদি তুমি নিতান্ত নির্বোিধ মূখ্য সরলা বালিকা হইতে, তাহা হইলেও সংসারে ভালোবাসা হইতে বঞ্চিত হইতে না— কিন্তু নাটকের নায়িকা স্টেজের উপরেই শোভা পায়, ঘরে তাহাকে লইয়া চলে না । কোথায় বিনোদিনীর সেই তীব্ৰ তেজ, দুঃসহ দপ। মন্ত্র্যাহত ফণিনীর মতো সে স্তব্ধ হইয়া নত ইয়াকুল অনেকক্ষণ পরে বিহারীর মুখের দিকে না চাহিয়া শান্তনগ্রস্তুৱে কহিল,"তুমি আমাকে কী 喃 বল ।” বিহারী কহিল, “অসাধারণ কিছু করিতে চাহিয়ে না। সাধারণ স্ত্রীলোকের শুভবুদ্ধি যাহা বলে, তাই করো। দেশে চলিয়া যাও।” বিনোদিনী । কেমন করিয়া যাইব । বিহারী। মেয়েদের গাড়িতে তুলিয়া দিয়া আমি তোমাকে তোমাদের স্টেশন পর্যন্ত পৌছাইয়া, दि বিনোদিনী । আজ রাত্রে তবে আমি এখানেই থাকি । বিহারী। না, এত বিশ্বাস আমার নিজের পরে নাই। শুনিয়া তৎক্ষণাৎ বিনোদিনী চৌকি হইতে ভূমিতে লুটাইয়া পড়িয়া, বিহারীর দুই পা প্ৰাণপণ বলে বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “ঐটুকু দুর্বলতা রাখো ঠাকুরপো! একেবারে পাথরের দেবতার মতো পবিত্র হইয়ো না। মন্দকে ভালোবাসিয়া একটুখানি মন্দ হও।” বলিয়া বিনোদিনী বিহারীর পদযুগল বার বার চুম্বন করিল। বিহারী বিনােদিনীর এই আকস্মিক অভাবনীয় ব্যবহারে ক্ষণকালের জন্য যেন আত্মসংবরণ করিতে পারিল না। তাহার শরীর-মনের সমস্ত