পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 じ○ গ্ৰন্থি যেন শিথিল হইয়া আসিল। বিনােদিনী বিহারীর এই স্তব্ধ বিহবল ভাব অনুভব করিয়া তাহার পা ছাডিয়া দিয়া নিজেই দুই হাটুর উপর উন্নত হইয়া উঠিল, এবং চৌকিতে আসীন বিহারীর গলদেশ বাহুতে বেষ্টন করিয়া বলিল, “জীবনসর্বস্ব, জানি তুমি আমার চিরকালের নও, কিন্তু আজ এক মুহুর্তের জন্য আমাকে ভালোবাসো । তার পরে আমি আমাদের সেই বনে-জঙ্গলে চলিয়া যাইব, কাহারও কাছে কিছুই চাহিব না । মরণ পর্যন্ত মনে রাখিবার মতো আমাকে একটা-কিছু দাও ।” বলিয়া বিনোদিনী চোখ বুজিয়া তাহার ওষ্ঠাধর বিহারীর কাছে অগ্রসর করিয়া দিল । মুহুর্তকালের জন্য দুই জনে নিশ্চল এবং সমস্ত ঘর নিস্তব্ধ হইয়া রহিল । তাহার পর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বিহারী ধীরে ধীরে বিনোদিনীর হাত ছাড়াইয়া লইয়া অন্য চৌকিতে গিয়া বসিল এবং রুদ্ধপ্ৰায় কণ্ঠস্বর পরিষ্কার করিয়া লইয়া কহিল, “আজি রাত্রি একটার সময় একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন আছে ।” বিনোদিনী একটুখানি স্তব্ধ হইয়া রহিল, তাহার পরে অস্ফুটিকণ্ঠে কহিল, “সেই ট্রেনেই যাইব ।” এমন সময়, পায়ে জুতা নাই, গায়ে জামা নাই, বসন্ত তাহার পরিস্ফুট গীেরসুন্দর দেহ লইয়া বিহারী জিজ্ঞাসা করিল, “শুতে যাস নি যে ?” বসন্ত কোনো উত্তর না দিয়া গম্ভীরমুখে দাড়াইয়া রহিল । বিনোদিনী দুই হাত বাড়াইয়া দিল। বসন্ত প্ৰথমে একটু দ্বিধা করিয়া, ধীরে ধীরে বিনোদিনীর কাছে গেল। বিনোদিনী তাহাকে দুই হাতে বুকের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া ঝরঝর করিয়া কঁদিতে লাগিল। \SV যাহা অসম্ভব তাহাও সম্ভব হয়, যাহা অসহ্য তাহাও সহ্য হয়, নহিলে মহেন্দ্রের সংসারে সে রাত্ৰি সে দিন কাটিত না। বিনোদিনীকে প্ৰস্তুত হইয়া থাকিতে পরামর্শ দিয়া মহেন্দ্র রাত্রেই একটা পত্ৰ লিখিয়াছিল, সেই পত্র ডাকযোগে সকালে মহেন্দ্রের বাড়িতে পৌছিল। আশা তখন শয্যাগত। বেহারা চিঠি হাতে করিয়া আসিয়া কহিল, “মাজি, চিটুঠি।” আশার হৃৎপিণ্ডে রক্ত ধক করিয়া ঘা দিল। এক পলকের মধ্যে সহস্ৰ আশ্বাস ও আশঙ্কা একসঙ্গে তাহার বক্ষে বাজিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি মাথা তুলিয়া চিঠিখানা লইয়া দেখিল, মহেন্দ্রের হাতের অক্ষরে বিনোদিনীর নাম। তৎক্ষণাৎ তাহার মাথা বালিশের উপরে পড়িয়া গেল— কোনো কথা না বলিয়া আশা সে চিঠি বেহারিার হাতে ফিরাইয়া দিল। বেহার জিজ্ঞাসা করিল, “চিঠি কাহাকে দিতে হইবে।” ऊष्ठां कशिळ्न, *ऊन् िन् ।।” উপস্থিত হইল, দেখিল— ঘরে আলো নাই, সমস্ত অন্ধকার। পকেট হইতে একটা দেশালাইয়ের বাক্স বাহির করিয়া দেশলাই ধরাইল— দেখিল, ঘর শূন্য। বিনোদিনী নাই, তাহার জিনিসপত্রও নাই। দক্ষিণের বারান্দায় গিয়া দেখিল, বারান্দা নির্জন ৷ ডাকিল, “বিনোদ ।” কোনো উত্তর আসিল না। “নির্বোধ। আমি নির্বোধি। তখনই সঙ্গে করিয়া লইয়া যাওয়া উচিত ছিল। নিশ্চয়ই মা বিনোদিনীকে এমন গঞ্জনা দিয়াছেন যে, সে ঘরে টিকিতে পারে নাই।” সেই কল্পনামাত্ৰ মনে উদয় হইতেই, তাহা নিশ্চয় সত্য বলিয়া তাহার মনে বিশ্বাস হইল। মহেন্দ্ৰ অধীর হইয়া তৎক্ষণাৎ মার ঘরে গেল। সে-ঘরেও আলো নাই— কিন্তু রাজলক্ষ্মী বিছানায় শুইয়া আছেন, তাহা অন্ধকারেও লক্ষ্য হইল। মহেন্দ্ৰ একেবারেই রুষ্টস্বরে বলিয়া উঠিল, “মা, তোমরা বিনোদিনীকে কী বলিয়াছ।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কিছুই বলি নাই।” মহেন্দ্র। তবে সে কোথায় গেছে ।