পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 V8 রবীন্দ্র-রচনাবলী রাজলক্ষ্মী। আমি কী জানি। h মহেন্দ্র অবিশ্বাসের স্বরে কহিল, “তুমি জান না ? আচ্ছা, আমি তাহার সন্ধানে চলিলাম— সে যেখানেই থাক, আমি তাহাকে বাহির করিবই।” বলিয়া মহেন্দ্ৰ চলিয়া গেল। রাজলক্ষ্মী তাড়াতাড়ি বিছানা হইতে উঠিয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিতে চলিতে বলিতে লাগিলেন, “মহিন, যাস নে মহিন, ফিরিয়া আয়, আমার একটা কথা শুনিয়া যা।” মহেন্দ্ৰ এক নিশ্বাসে ছুটিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল। মুহুর্ত পরেই ফিরিয়া আসিয়া দরোয়ানকে জিজ্ঞাসা করিল, “বহুঠাকুরানী কোথায় গিয়াছেন।” দরোয়ান কহিল, “আমাদের বলিয়া যান নাই, আমরা কিছুই জানি না।” মহেন্দ্ৰ গৰ্জিত ভৎসনার স্বরে কহিল, “জান না !” দরোয়ান করজোড়ে কহিল, “না মহারাজ, জানি না।” মহেন্দ্ৰ মনে মনে স্থির করিল, “মা ইহাদের শিখাইয়া দিয়াছেন।” কহিল, “আচ্ছা, তা হউক।” মহানগরীর রাজপথে গ্যাসালোকবিদ্ধ সন্ধ্যান্ধকারে বরফওয়ালা তখন বরফ ও তপসিমাছওয়ালা তপসিমাছ হাকিতেছিল। কলরবক্ষুব্ধ জনতার মধ্যে মহেন্দ্ৰ প্ৰবেশ করিল এবং অদৃশ্য হইয়া গেল। \S) বিহারী একলা নিজেকে লইয়া অন্ধকার রাত্রে কখনো ধ্যান করিতে বসে না। কোনোকালেই বিহারী নিজের কাছে নিজেকে আলোচ্য বিষয় করে নাই। সে পড়াশুনা কাজকর্ম বন্ধুবান্ধব লোকজন লইয়াই থাকিত । চারি দিকের সংসারকেই সে নিজের চেয়ে প্রাধান্য দিয়া আনন্দে ছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন প্ৰবল আঘাতে তাহার চারি দিক যেন বিশ্লিষ্ট হইয়া পড়িয়া গেল ; প্রলয়ের অন্ধকারে অভ্ৰভেদী বেদনার গিরিশৃঙ্গে নিজেকে একলা লইয়া দাড়াইতে হইল। সেই হইতে নিজের নির্জন সঙ্গকে সে ভয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে ; জোর করিয়া নিজের ঘাড়ে কাজ চাপাইয়া এই সঙ্গীটিকে সে কোনোমতেই অবকাশ দিতে চায় না। কিন্তু আজ নিজের সেই অন্তরবাসীকে বিহারী কোনোমতেই ঠেলিয়া রাখিতে পারিল না। কাল বিনোদিনীকে বিহারী দেশে পৌছাইয়া দিয়া আসিয়াছে, তাহার পর হইতে সে যে-কোনো কাজে যে-কোনো লোকের সঙ্গেই আছে, তাহার গুহাশায়ী বেদনাতুর হৃদয় তাহাকে নিজের নিগৃঢ় নির্জনতার দিকে অবিশ্রাম আকর্ষণ করিতেছে। শ্ৰান্তি ও অবসাদে আজ বিহারীকে পরাস্ত করিল। রাত্রি তখন নয়টা হইবে ; বিহারীর গৃহের সম্মুখবতী দক্ষিণের ছাদের উপর দিনান্তরম্য গ্ৰীষ্মের বাতাস উতলা হইয়া উঠিয়াছে। বিহারী চন্দ্ৰোদয়হীন অন্ধকারে ছাদে একখানি কেদারা লইয়া বসিয়া আছে। বালক বসন্তকে আজ সন্ধ্যাবেলায় সে পড়ায় নাই- সকাল সকাল তাহাকে বিদায় করিয়া দিয়াছে। আজ সাস্ত্ৰনার জন্য, সঙ্গের জন্য, তাহার চিরাভ্যস্ত প্রীতিসুধাম্বিন্ধ পূর্বজীবনের জন্য তাহার হৃদয় যেন মাতৃপরিত্যক্ত শিশুর মতো বিশ্বের অন্ধকারের মধ্যে দুই বাহু তুলিয়া কাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। আজ তাহার দৃঢ়তা, তাহার কঠোর সংযমের বঁাধ কোথায় ভাঙিয়া গেছে। যাহাদের কথা ভাবিবে না পণ করিয়াছিল, সমস্ত হৃদয় তাহাদের দিকে ছুটিয়াছে, আজ আর পথরোধ করিবার লেশমাত্র বল নাই। মহেন্দ্রের সহিত বাল্যকালের প্রণয় হইতে সেই প্ৰণয়ের অবসান পর্যন্ত সমস্ত কথা— যে সুদীর্ঘ কাহিনী নানাবর্ণে চিত্রিত, জলে-স্থলে পর্বতে নদীতে বিভক্ত মানচিত্রের মতো তাহার মনের মধ্যে গুটানো ছিল— বিহারী প্রসারিত করিয়া ধরিল। যে ক্ষুদ্র জগৎটুকুর উপর সে তাহার জীবনের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল, তাহা কোনখানে কোন দুগ্রহের সহিত সংঘাত পাইল, তাহাই সে মনে করিয়া দেখিতে