পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 VA করিয়া রাত্রে কোন দেবতার ধ্যানে কোন পুণ্যমন্ত্র জপ করিতেছিলে ? ভণ্ড !” বলিয়া, ছবিখানি মহেন্দ্ৰ ভূমিতে ফেলিয়া জুতাসুদ্ধ পা দিয়া তাহার কাচ চূৰ্ণ চুৰ্ণ করিল এবং প্ৰতিমূর্তিটি লইয়া টুকরা টুকরা করিয়া ছিড়িয়া বিহারীর গায়ের উপর ফেলিয়া দিল। তাহার মত্ততা দেখিয়া বসন্ত আবার ভয়ে কাদিয়া উঠিল। বিহারীর কণ্ঠ রুদ্ধপ্ৰায় হইয়া আসিল- দ্বারের দিকে হস্তনির্দেশ করিয়া কহিল, “যাও।” মহেন্দ্ৰ বাড়ের বেগে বাহিব হইয়া চলিয়া গেল। WSDbr বিনোদিনী যখন যাত্রিশূন্য মেয়েদের গাড়িতে চড়িয়া বাতায়ন হইতে চযামাঠ ও ছায়াবেষ্টিত এক-একখানি গ্রাম দেখিতে পাইল, তখন তাহার মনে স্নিগ্ধনিভূত পল্লীর জীবনযাত্রা জাগিয়া উঠিল। সেই তরুচ্ছায়াবেষ্টিনের মধ্যে তাহার স্বরচিত কল্পনা-নীড়ে নিজের প্রিয় বইগুলি লইয়া কিছুকাল নগরবাসের সমস্ত ক্ষোভ, দাহ ও ক্ষতিবেদনা হইতে সে শান্তিলাভ করিতে পরিবে, এই কথা তাহার মনে হইতে লাগিল। গ্ৰীষ্মের শস্যশূন্য দিগন্তপ্রসারিত ধূসর মাঠের মধ্যে সূর্যস্তদৃশ্য দেখিয়া বিনোদিনী ভাবিতে লাগিল, আর যেন কিছুর দরকার নাই— মন যেন এইরূপ সুবৰ্ণরঞ্জিত স্তব্ধ বিস্তীর্ণ শান্তির মধ্যে সমস্ত ভুলিয়া দুই চক্ষু মুদ্রিত করিতে চায়, তরঙ্গবিক্ষব্ধ সুখদুঃখসাগর হইতে জীবনতরীটি তীরে ভিড়াইয়া নিঃশব্দ সন্ধ্যায় একটি নিষ্কম্প বটবৃক্ষের তলায় বাধিয়া রাখিতে চায়, আর কিছুতেই কোনো প্রয়োজন নাই। গাড়ি চলিতে চলিতে এক-এক জায়গায় আম্রকুঞ্জ হইতে মুকুলের গন্ধ আসিতেই পল্লীর স্নিগ্ধশান্তি তাহাকে নিবিড়ভাবে আবিষ্ট করিয়া তুলিল। মনে মনে সে কহিল, “ বেশি হইয়াছে, ভালোই হইয়াছে, নিজেকে লইয়া আর টানাছেড়া করিতে পারি না— এবারে সমস্ত ভুলিব, ঘুমাইব—- পাড়াগায়ের মেয়ে হইয়া ঘরের ও পল্লীর কাজে কর্মে সন্তোষের সঙ্গে, আরামের সঙ্গে জীবন কাটাইয়া দিব ।” তুষিত বক্ষে এই শান্তির আশা বহন করিয়া বিনোদিনী আপনার কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করিল। কিন্তু হায়, শান্তি কোথায়। কেবল শূন্যতা এবং দারিদ্র্য। চারি দিকেই সমস্ত জীর্ণ, অপরিচ্ছন্ন, অনাদৃত, মলিন । বহুদিনের রুদ্ধ স্যাতসেতে ঘরের বাম্পে তাহার যেন নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিল । ঘরে অল্পস্বল্প যে-সমস্ত আসবাবপত্র ছিল, তাহা কীটের দংশনে, ইদুরের উৎপাতে ও ধুলার আক্রমণে ছারখার হইয়া আসিয়াছে। সন্ধ্যার সময় বিনোদিনী ঘরে গিয়া পৌছিল— ঘর নিরানন্দ অন্ধকার । কোনোমতে সরষের তোলে প্ৰদীপ জ্বালাইতেই তাহার ধোয়ায় ও ক্ষীণ আলোতে ঘরের দীনতা আরো পরিস্ফুট হইল। আগে যাহা তাহাকে পীড়ন করিত না, এখন তাহা অসহ্য বোধ হইতে লাগিল— তাহার সমস্ত বিদ্রোহী অন্তঃকরণ সবলে বলিয়া উঠিল, “এখানে তো এক মুহুর্ত ও কাটিবে না।” কুলুঙ্গিতে পূর্বেকার দুই-একটা ধুলায়-আচ্ছন্ন বই ও মাসিক পত্ৰ পড়িয়া আছে, কিন্তু তাহা ছুইতে ইচ্ছা হইল না। বাহিরের বায়ুসম্পর্কশন্য আমবাগানে ঝিল্লি ও মশার গুঞ্জনস্বর অন্ধকারে ধ্বনিত হইতে লাগিল। জামাইবাড়িতে গিয়াছেন। বিনোদিনী প্রতিবেশিনীদের বাড়িতে গেল। তাহারা তাহাকে দেখিয়া যেন চকিত হইয়া উঠিল। ও মা, বিনোদিনীর দিব্য রঙ সাফ হইয়া উঠিয়াছে, কাপড়াচোপড় ফিটফাট, যেন মেমসাহেবের মতো। তাহারা পরস্পরে কী যেন ইশারায় কহিয়া বিনোদিনীর প্রতি লক্ষ করিয়া মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিল। যেন কী একটা জনরব শোনা গিয়াছিল, তাহার সহিত লক্ষণ মিলিল। বিনােদিনী তাহার পল্লী হইতে সর্বতোভাবে বহু দূরে গিয়া পড়িয়াছে, তাহা পদে-পদে অনুভব করিতে লাগিল। স্বগৃহে তাহার নির্বাসন। কোথাও তাহার এক মুহুর্তের আরামের স্থান নাই । ডাকঘরের বুড়ো পেয়াদা বিনোদিনীর আবাল্যপরিচিত। পরদিন বিনোদিনী যখন পুষ্করিণীর ঘাটে