পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8br8 রবীন্দ্র-রচনাবলী কী লজা। আশা কি মহেন্দ্রকে উপরের ঘরে শুইতে যাইবার জন্য সাধিতে আসিয়াছিল । ঘর হইতে সে বাহির হইতেই রাজলক্ষ্মী বিরক্তির স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী, হইল কী ।” আশা কহিল, “তিনি এখন পড়িতেছেন, নীচেই শুইবেন।” বলিয়া সে নিজের অপমানিত শয়নগহে আসিয়া প্ৰবেশ করিল। কোথাও তাহার সুখ নাই— সমস্ত পৃথিবী সর্বত্রই যেন মধ্যাহ্নের মরু-ভূতলের মতো তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। খানিক রাত্রে আশার শয়নগৃহের রুদ্ধদ্বারে ঘা পড়িল, “বউ, বউ, দরজা খোলো।” ভাঙা গলায় কহিলেন, “বাউ, তোমার রকম কী। উপরে আসিয়া দ্বার বন্ধ করিয়াছ যে ! এখন কি এইরকম রাগারগি করিবার সময় ! এত দুঃখেও তোমার ঘটে বুদ্ধি আসিল না। যাও, নীচে যাও।” রাজলক্ষ্মী। একলা থাকিবে বলিলেই হইল। রাগের মুখে সে কী কথা বলিয়াছে, তাই শুনিয়া অমনি বাকিয়া বসিতে হইবে ! এত অভিমানী হইলে চলে না। যাও, শীঘ্ৰ যাও । দুঃখের দিনে বধুর কাছে শাশুড়ির আর লজ্জা নাই। তাহার হাতে যে-কিছু উপায় আছে, তাহাই দিয়া মহেন্দ্ৰকে কোনোমতে বাধিতেই হইবে । আবেগের সহিত কথা কহিতে কহিতে রাজলক্ষ্মীর পুনরায় অত্যন্ত শ্বাসকষ্ট হইল। কতকটা সংবরণ করিয়া তিনি উঠিলেন। আশাও দ্বিরুক্তি না করিয়া তাহাকে ধরিয়া লইয়া নীচে চলিল । রাজলক্ষ্মীকে আশা তাহার শযনঘরে বিছানায় বসাইয়া, তাকিয়াবালিশগুলি পিঠের কাছে ঠিক করিয়া দিতে লাগিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “থাক, বউমা, থাক। সুধোকে ডাকিয়া দাও । তুমি যাও, আর দেরি করিয়ো না।” আশা এবার আর দ্বিধামাত্ৰ করিল না। শাশুড়ির ঘর হইতে বাহির হইয়া একেবারে মহেন্দ্রের ঘরে গিয়া উপস্থিত হইল। মহেন্দ্রের সম্মুখে টেবিলের উপর খোলা বই পড়িয়া আছে- সে টেবিলের উপর দু পা তুলিয়া দিয়া চৌকির উপর মাথা রাখিয়া একমনে কী ভাবিতেছিল। পশ্চাতে পদশব্দ শুনিয়া একেবারে চমকিয়া উঠিয়া ফিরিয়া তাকাইল । যেন কাহার ধানে নিমগ্ন ছিল, হঠাৎ ভ্ৰম হইয়াছিল, সে-ই বুঝি আসিয়াছে। আশাকে দেখিয়া মহেন্দ্ৰ সংযত হইয়া পা নামাইয়া খোলা বইটা কোলে টানিয়া লইল । মহেন্দ্ৰ আজি মনে মনে আশ্চর্য হইল। আজকাল তো আশা এমন অসংকোচে তাহার সম্মুখে আসে না- দৈবাৎ তাহদের উভয়ের সাক্ষাৎ হইলে সে তখনই চলিয়া যায়। আজ এত রাত্রে এমন সহজে সে যে তাহার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল, এ বড়ো বিস্ময়কর। মহেন্দ্ৰ তাহার বই হইতে মুখ না তুলিয়াই বুঝিল, আশার আজ চলিয়া যাইবার লক্ষণ নহে। আশা মহেন্দ্রের সম্মুখে স্থিরভাবে আসিয়া দাড়াইল। তখন মহেন্দ্ৰ আর পড়িবার ভান করিতে পারিল না— মুখ তুলিয়া চাহিল। আশা সুস্পষ্ট স্বরে কহিল, “মার হাপানি বাড়িয়াছে, তুমি একবার তাহাকে দেখিলে ভালো হয়।” মহেন্দ্ৰ । তিনি কোথায় আছেন ? আশা । তাহার শোবার ঘরেই আছেন, ঘুমাইতে পারিতেছেন না। মহেন্দ্র । তবে চলো, তাহাকে দেখিয়া আসি গে। অনেক দিনের পরে আশার সঙ্গে এইটুকু কথা কহিয়া মহেন্দ্ৰ যেন অনেকটা হালকা বোধ করিল। নীরবতা যেন দুৰ্ভেদ্য দুর্গপ্রাচীরের মতো স্ত্রীপুরুষের মাঝখানে কালো ছায়া ফেলিয়া দাড়াইয়া ছিল, মহেন্দ্রের তরফ হইতে তাহা ভাঙিবার কোনো অস্ত্র ছিল না— এমন সময় আশা স্বহস্তে কেল্লার একটি ছোটাে দ্বার খুলিয়া দিল । ঘরে আসিতে দেখিয়া রাজলক্ষ্মী ভীত হইলেন, ভাবিলেন, বুঝি বা আশার সঙ্গে রাগারগি করিয়া