পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 N 3) সমস্ত দিনের উপবাসে ও কষ্টে তাহার শরীর-মন শ্রান্ত ও অবসন্ন। পাড়ার বাড়িতে সেদিন থাকিয়া থাকিয়া বিবাহের বাদ্য বাজিতেছিল। এই সময়ে সানাইয়ে আবার সুর ধরিল। সেই রাগিণীর আঘাতে রাত্রির সমস্ত অন্ধকার যেন স্পন্দিত হইয়া আশাকে বারংবার যেন অভিঘাত করিতে লাগিল। তাহার বিবাহরাত্রির প্রত্যেক ক্ষুদ্র ঘটনাটিও সজীব হইয়া রাত্রির আকাশকে স্বপ্নচ্ছবিতে পূৰ্ণ করিয়া বিবধূর শঙ্কিত লজ্জিত আনন্দিত হৃদয়ের নিগৃঢ় কম্পন— সমস্তই স্মৃতির আকারে যতই তাহাকে চারি দিকে আবিষ্ট করিয়া ধরিল, ততই তাহার হৃদয়ের ব্যথা প্ৰাণ পাইয়া বল করিতে লাগিল। দারুণ দুর্ভিক্ষে ক্ষুধিত বালক যেমন খাদ্যের জন্য মাতাকে আঘাত করিতে থাকে, তেমনি জাগ্ৰত সুখের স্মৃতি আপনার খাদ্য চাহিয়া আশার বক্ষে বারংবার সরোদন করাঘাত করিতে লাগিল। অবসন্ন আশাকে আর পড়িয়া থাকিতে দিল না। দুই হাত জোড় করিয়া দেবতার কাছে প্রার্থনা করিতে গিয়া সংসারে তার একমাত্র প্রত্যক্ষ দেবতা মাসিমার পবিত্র স্নিগ্ধ মূর্তি আশার অশ্রুবাম্পাচ্ছন্ন হৃদয়ের মধ্যে আবির্ভূত হইল। পুনরায় সংসারের দুঃখ-কঞাটে সেই তাপসীকে আহবান করিয়া আনিবে না, এতদিন ইহাই তাহাব প্ৰতিজ্ঞা ছিল। কিন্তু আজ সে আর কোথাও কোনো উপায় দেখিতে পাইল না- আজ তাহার চতুর্দিকে ঘনায়িত নিবিড় দুঃখের মধ্যে আর রন্ধমাত্র ছিল না। তাই আজ সে ঘরের মধ্যে আলো জ্বালিয়া কোলের উপর একখানা খাতায় চিঠির কাগজ রাখিয়া ঘনঘন চোখের জল মুছিতে মুছিতে চিঠি লিখিতে লাগিল ‘শ্ৰীচরণকমলেষু— মাসিমা, তুমি ছাড়া আজ আমার আর কেহ নাই ; একবার আসিয়া তোমার কোলের মধ্যে এই দুঃখিনীকে টানিয়া লাও । নহিলে আমি কেমন করিয়া বঁচিব । আর কী লিখিব, জানি না ! তোমার চরণে আমার শতসহস্ৰ কোটি প্ৰণাম | তোমার মেহের চুনি।” Տ Գ অন্নপূর্ণ কাশী হইতে ফিরিয়া আসিয়া অতি ধীরে ধীরে রাজলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিয়া প্ৰণামপূর্বক তাহার পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া লইলেন। মাঝখানের বিরোধবিচ্ছেদ সত্ত্বেও অন্নপূর্ণাকে দেখিয়া রাজলক্ষ্মী যেন হারানো ধন ফিরিয়া পাইলেন। ভিতরে ভিতরে তিনি যে নিজের অলক্ষ্যে অগোচরে অন্নপূর্ণাকে চাহিতেছিলেন, অন্নপূর্ণাকে পাইয়া তাহা বুঝিতে পারিলেন। তাহার এতদিনের অনেক শ্রান্তি অনেক ক্ষোভ যে কেবল অন্নপূর্ণার অভাবে, অনেক দিনের পরে আজ তাহা তাহার কাছে মুহূর্তের মধ্যে সুস্পষ্ট হইল। মুহূর্তের মধ্যে তাহার সমস্ত ব্যথিত হৃদয় তাহার চিরন্তন স্থানটি অধিকার করিল। মহেন্দ্রের জন্মের পূর্বেও এই দুটি জা। যখন বন্ধুভাবে এই পরিবারের সমস্ত সুখদুঃখকে বরণ করিয়া লইয়াছিলেন— পূজায় উৎসবে, শোকে মৃত্যুতে, উভয়ে এই সংসার-রথে একত্রে যাত্রা করিয়াছিলেন— তখনকার সেই ঘনিষ্ঠ সখিত্ব রাজলক্ষ্মীর হৃদয়কে আজ মুহুর্তের মধ্যে আচ্ছন্ন করিয়া দিল। যাহার সঙ্গে সুদূর অতীতকালে একত্রে জীবন আরম্ভ করিয়াছিলেন, নানা ব্যাঘাতের পর সেই বাল্যসহচরীই পরম দুঃখের দিনে তাহার পার্শ্ববর্তিনী হইলেন— তখনকার সমস্ত সুখদুঃখের, সমস্ত প্রিয় ঘটনার এই একটিমাত্র স্মরণাশ্রয় রহিয়াছে। যাহার জন্য রাজলক্ষ্মী ইহাকেও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করিয়াছিলেন, সেই বা আজ কোথায় ! অন্নপূর্ণ রোগিণীর পাশ্বে বসিয়া তাহার দক্ষিণ হস্ত হস্তে লইয়া কহিলেন, “帘门 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ মেজোবউ।” বলিয়া আর তাহার কথা বাহির হইল না। তাহার দুই চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল। আশা এই দৃশ্য দেখিয়া আর থাকিতে পারিল না— পাশের ঘরে গিয়া মাটিতে বসিয়া কাদিতে লাগিল ।