পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(? > ○ রবীন্দ্র-রচনাবলী বিহারীকে খাওয়াইব ।” শুনিয়া বিহারীর চোখ ছলছল করিয়া আসিল । জিজ্ঞাসা করিল, “মা আছেন কেমন ।” আশা কহিল, “তুমি একবার নিজে দেখিবে এসো— আমার তো বোধ হয়, ব্যামো আরো বাডিয়াছে।” তখন বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। মহেন্দ্ৰ বাহিরে দাড়াইয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। আশা বাড়ির কর্তৃত্ব অনায়াসে গ্রহণ করিয়াছে- সে মহেন্দ্ৰকে কেমন সহজে ঘরে ঢুকিতে নিষেধ করিল। না করিল সংকোচ, না করিল অভিমান। মহেন্দ্রের বল আজি কতখানি কমিয়া গেছে। সে অপরাধী, সে বাহিরে চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল- মার ঘরেও ঢুকিতে পারিল না। তাহার পরে ইহাও আশ্চর্য— বিহারীর সঙ্গে আশা কেমন অকুষ্ঠিতভাবে কথাবার্তা কহিল। সমস্ত পরামর্শ তাহারই সঙ্গে। সেই আজ সংসারের একমাত্র রক্ষক, সকলের সুহৃৎ। তাহার গতিবিধি সর্বত্র, তাহার উপদেশেই সমস্ত চলিতেছে। মহেন্দ্ৰ কিছুদিনের জন্য যো-জায়গাটি ছাড়িয়া চলিয়া গেছে, ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, সে-জায়গা ঠিক আর তেমনটি নাই। বিহারী ঘরে ঢুকিতেই রাজলক্ষ্মী তাহার করুণ চক্ষু তাহার মুখের দিকে রাখিয়া কহিলেন, “বিহারী, ফিরিয়াছিস ?” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তোর কাজ শেষ হইয়া গেছে ?” বলিয়া তাহার মুখের দিকে একাগ্ৰদূষ্টিতে চাহিলেন । বিহারী প্ৰফুল্লমুখে “ই মা, কাজ সুসম্পন্ন হইয়াছে, এখন আমার আর-কোনো ভাবনা নাই” বলিয়া একবার বাহিরের দিকে চাহিল। রাজলক্ষ্মী। আজ বউমা তোমার জন্য নিজের হাতে রাধিবেন, আমি এখান হইতে দেখাইয়া দিব । ডাক্তার বারণ করে- কিন্তু আর বারণ কিসের জন্য, বাছা । আমি কি একবার তোদের খাওয়া দেখিয়া যাইব না । বিহারী কহিল, “ডাক্তারের বারণ করিবার তো কোনো হেতু দেখি না, মা— তুমি না দেখাইয়া দিলে চলিবে কেন। ছেলেবেলা হইতে তোমার হাতের রান্নাই আমরা ভালোবাসিতে শিখিয়াছি— মহিনদার তো পশ্চিমের ডালরুটি খাইয়া অরুচি ধরিয়া গেছে- আজি সে তোমার মাছের ঝোল পাইলে বাচিয়া যাইবে । আজ আমরা দুই ভাই ছেলেবেলাকার মতো রেষারেষি করিয়া খাইব, তোমার বউমা অন্নে কুলাইতে পারিলে হয়।” শুনিতেই তাহার হৃদয় স্পন্দিত হইয়া নিশ্বাস ক্ষণকালের জন্য কঠিন হইয়া উঠিল। সে-ভাবটা কাটিয়া গেলে বিহারী কহিল, “পশ্চিমে গিয়া মহিনদার শরীর অনেকটা ভালো হইয়াছে। আজ পথের অনিয়মে সে একটু স্নান আছে, স্নানাহার করিলেই শুধরাইয়া উঠিবে।” রাজলক্ষ্মী তবু মহেন্দ্রের কথা কিছু বলিলেন না। তখন বিহারী কহিল, “মা, মহিনদা বাহিরেই দাড়াইয়া আছে, তুমি না ডাকিলে সে তো আসিতে পারিতেছে না।” রাজলক্ষ্মী কিছু না বলিয়া দরজার দিকে চাহিলেন। চাহিতেই বিহারী ডাকিল, “মহিনদা, এসো।” মহেন্দ্ৰ ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করিল। পাছে হৃৎপিণ্ড হঠাৎ স্তব্ধ হইয়া যায়, এই ভয়ে রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের মুখের দিকে তখনই চাহিতে পারিলেন না। চক্ষু অর্ধনিমীলিত করিলেন। মহেন্দ্ৰ বিছানার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া চমকিয়া উঠিল, তাহাকে কে যেন মারিল। মহেন্দ্ৰ মাতার পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া পা ধরিয়া পড়িয়া রহিল। বক্ষের স্পন্দনে রাজলক্ষ্মীর সমস্ত শরীর কঁপিয়া কঁপিয়া উঠিল। কিছু পরে অন্নপূর্ণ ধীরে ধীরে কহিলেন, “দিদি, মহিনকে তুমি উঠিতে বলো, নহিলে ও | |° রাজলক্ষ্মী কষ্টে বাক্যস্ফুরণ করিয়া কহিলেন, “মহিন, ওঠ।”