পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰজাপতির নির্বন্ধ (շ Ֆ Գ শ্ৰীশের বন্ধুত্ব অবিচ্ছেদ্য। পূৰ্ণ গৌরবর্ণ, একহারা, লঘুগামী, ক্ষিপ্রকারী, দ্রুতভাষী, সকল বিষয়ে গাঢ় মনোযোগ, চেহারা দেখিয়া মনে হয় দৃঢ় সংকল্প কাজের লোক । সে ছিল চন্দ্ৰমাধববাবুর ছাত্র। ভালোরূপ পাস করিয়া ওকালতি-দ্বারা সুচারুরূপ জীবিকা নির্বাহ করিবার প্রত্যাশায় সে রাত জাগিয়া পড়া করে । দেশের কাজ লইয়া নিজের কাজ নষ্ট করা তাহার সংকল্পের মধ্যে ছিল না। চিরকৌমার্য তাহার কাছে অত্যন্ত মনোহর বলিয়া বোধ হইত না । সন্ধ্যাবেলায় নিয়মিত আসিয়া চন্দ্ৰবাবুর নিকট হইতে পাস করিবার উপযুক্ত নোট লাইত ; এবং সে মনে মনে নিশ্চয় জানিত যে, চিরকীেমাৰ্যব্রত না লওয়াতে এবং নিজের ভবিষ্যৎ মাটি করিবার জন্য লেশমাত্র ব্যগ্ৰ না হওয়াতে তাহার প্রতি চন্দ্ৰীমাধববাবুর শ্রদ্ধামাত্র ছিল না, কিন্তু সেজন্য সে কখনো অসহ্য দুঃখানুভব করে নাই। তার পরে কী ঘটিল। তাহা সকলেই জানেন । সেদিন সভা বসিয়াছে। চন্দ্ৰীমাধববাবু বলিতেছেন, “আমাদের এই সভার সভ্যসংখ্যা অল্প হওয়াতে কারও হতাশ্বাস হবার কোনো কারণ নেই- ” তাহার কথা শেষ না হইতেই রুগণকায় উৎসাহী শ্ৰীশ বলিয়া উঠিল, “হতাশ্বাস! সেই তো আমাদের সভার গৌরব ! এ সভার মহৎ আদর্শ এবং কঠিন বিধান কি সর্বসাধারণের উপযুক্ত ! আমাদের সভা অল্প লোকের সভা ।” চন্দ্ৰীমাধববাবু কাৰ্যবিবরণের খাতাটা চোখের কাছে তুলিয়া ধরিয়া কহিলেন, “কিন্তু আমাদের আদর্শ উন্নত এবং বিধান কঠিন বলেই আমাদের বিনয় রক্ষা করা কর্তব্য ; সর্বদাই মনে রাখা উচিত আমরা আমাদের সংকল্প-সাধনের যোগ্য না হতেও পারি। ভেবে দেখো পূর্বে আমাদের মধ্যে এমন অনেক সভ্য ছিলেন যারা হয়তো আমাদের চেয়ে সর্বাংশে মহত্তর ছিলেন, কিন্তু তারাও নিজের সুখ এবং সংসারের প্রবল আকর্ষণে একে একে লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হয়েছেন । আমাদের কয়জনের পথেও যে প্রলোভন কোথায় অপেক্ষা করছে তা কেউ বলতে পারে না । সেইজন্য আমরা দম্ভ পরিত্যাগ করব, এবং কোনোরকম শপথেও বদ্ধ হতে চাই নে— আমাদের মত এই যে, কোনোকালে মহৎ চেষ্টাকে মনে স্থান না দেওয়ার চেয়ে চেষ্টা করে অকৃতকার্য হওয়া ভালো ।” পাশের ঘরে ঈষৎ মুক্ত দরজার অন্তরালে একটি শ্রোত্রা এই কথায় যে একটুখানি বিচলিত হইয়া উঠিল, তাহার অঞ্চলবদ্ধ চাবির গোছায় দুই-একটা চাবি যে একটু ঠন শব্দ করিল তাহা পূর্ণ ছাড়া আর কেহ লক্ষ্য করিতে পারিল না। চন্দ্ৰীমাধববাবু বলিতে লাগিলেন, “আমাদের সভাকে অনেকেই পরিহাস করেন ; অনেকে বলেন তোমরা দেশের কাজ করবার জন্য কৌমাৰ্যব্রত গ্রহণ করছ, কিন্তু সকলেই যদি এই মহৎ প্ৰতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয় তা হলে পঞ্চাশ বৎসর পরে দেশে এমন মানুষ কে থাকবে যার জন্যে কোনো কাজ করা কারো দরকার হবে । আমি প্রায়ই নম্র নিরুত্তরে এই-সকল পরিহাস বহন করি ; কিন্তু এর কি কোনো উত্তর নেই ?” বলিয়া তিনি তাহার তিনটি মাত্ৰ সভ্যোর দিকে চাহিলেন । , পূৰ্ণ নেপথ্যবাসিনীকে স্মরণ করিয়া সোৎসাহে কহিল, “আছে বৈকি। সকল দেশেই একদল মানুষ আছে যারা সংসারী হবার জন্যে জন্মগ্রহণ করে নি, তাদের সংখ্যা অল্প। সেই কটিকে আকর্ষণ করে এক-উদ্দেশ্য-বন্ধনে বঁাধবার জন্যে আমাদের এই সভা, সমস্ত জগতের লোককে কৌমাৰ্যব্রতে দীক্ষিত করবার জন্যে নয়। আমাদের এই জাল অনেক লোককে ধরবে এবং অধিকাংশকেই পরিত্যাগ করবে, অবশেষে দীর্ঘকাল পরীক্ষার পর দুটি-চারটি লোক থেকে যাবে। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে তোমরাই ৰ্কি সেই দুটি-চারটি লোক, তবে স্পর্ধাপূর্বক কে নিশ্চয়রূপে বলতে পারে। হা আমরা জালে আকৃষ্ট হয়েছি। এই পর্যন্ত, কিন্তু পরীক্ষায় শেষ পর্যন্ত টিকতে পারব কি না তা অন্তর্যামীই জানেন। কিন্তু আমরা কেউ টিকতে পারি বা না পারি, আমরা একে একে স্বলিত হই বা না হই, তাই বলে আমাদের এই সভাকে পরিহাস করবার অধিকার কারও নেই। কেবল যদি আমাদের সভাপতিমশায় একলা মাত্র