পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰজাপতির নির্বন্ধ ○ ○。 বিচারে পালন করে যাব। কাৰ্যসাধন এবং ঐক্যসাধনের এই একমাত্র উপায় আছে।” পাশের ঘরে এক ব্যক্তি আবার একবার নড়িয়া চড়িয়া বসিল এবং তাহার চাবি ঝন করিয়া छेठिंब्ल ! বিষয়াকর্মে চন্দ্ৰীমাধববাবুর মতো অপটু কেহ নাই। কিন্তু তাহার মনের খেয়াল বাণিজ্যের দিকে। তিনি বলিলেন, “আমাদের প্রথম কর্তব্য ভারতবর্ষের দারিদ্র্যামোচন এবং তার আশু উপায় বাণিজ্য। আমরা কয়জনে বড়ো বাণিজ্য চালাতে পারি নে, কিন্তু তার সূত্রপাত করতে পারি। মনে করো আমরা সকলেই যদি দিয়াশালাই সম্বন্ধে পরীক্ষা আরম্ভ করি। এমন যদি একটা কাঠি বের করতে পারি যা সহজে জ্বলে, শীঘ্ৰ নেবে না এবং দেশের সর্বত্র প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, তা হলে দেশে সস্তা দেশালাই নির্মাণের কোনো বাধা থাকে না।” এই বলিয়া জাপানে এবং যুরোপে সবসুদ্ধ কত দেশালাই প্রস্তুত হয়, তাহাতে কোন কোন কাঠের কাঠি ব্যবহার হয়, কাঠির সঙ্গে কী কী দাহ্য পদাৰ্থ মিশ্রিত করে, কোথা হইতে কত দেশালাই রপ্তানি হয়, তাহার মধ্যে কত ভারতবর্ষে আসে এবং তাহার মূল্য কত চন্দ্ৰীমাধববাবু তাহা বিস্তারিত করিয়া বলিলেন। বিপিন শ্ৰীশ নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। পূর্ণ কহিল, “পাকাটি এবং খ্যাংরা কাঠি দিয়ে শীঘ্রই পরীক্ষা করে দেখব ।” শ্ৰীশ মুখ ফিরাইয়া হাসিল। এমন সময়ে ঘরের মধ্যে অক্ষয় আসিয়া প্ৰবেশ করিলেন | কহিলেন, “মশায়, প্ৰবেশ করতে পারি ?” ক্ষীণদৃষ্টি চন্দ্ৰমাধববাবু হঠাৎ চিনিতে না পারিয়া ভ্ৰকুঞ্চিত করিয়া অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন। অক্ষয় কহিলেন, “মশায়, ভয় পাবেন না এবং অমান ভুকুটি করে আমাকেও ভয় দেখাবেন না— আমি অভূতপূর্ব নাই— এমন-কি, আমি আপনাদেরই ভূতপূর্ব— আমার নাম—” চন্দ্ৰীমাধববাবু তাড়াতাড়ি উঠিয়া কহিলেন, “আর নাম বলতে হবে না— আসুন আসুন অক্ষয়বাবু-” তিন তরুণ সভা অক্ষয়কে নমস্কার করিল। বিপিন ও শ্ৰীশ দুই বন্ধু সদ্যোবিবাদের বিমৰ্ষতায় গম্ভীর হইয়া বসিয়া বহিল। পূর্ণ কহিল, “মশায়, অভূতপূর্বের চেয়ে ভূতপূর্বকেই বেশি ভয় হয়।” অক্ষয় কহিলেন, “পূৰ্ণবাবু বুদ্ধিমানের মতো কথাই বলেছেন। সংসারে ভূতের ভয়টাই প্রচলিত। নিজে যে ব্যক্তি ভূত অনালোকের জীবনসম্ভোগটা তার কাছে বাঞ্ছনীয় হতে পারেই না, এই মনে করে মানুষ ভুতকে ভয়ংকর কল্পনা করে। অতএব সভাপতি মশায়, চিরকুমার-সভার ভূতটিকে সভা থেকে ঝাড়াবেন না পূর্ব-সম্পর্কের মমতাবশত একখানা চৌকি দেবেন, এইবেল বলুন।” “ চৌকি দেওয়াই স্থির” বলিয়া চন্দ্ৰবাবু একখানি চেয়ার অগ্রসর করিয়া দিলেন। নিতান্ত ভদ্রতা করে বসতে বললেন বলেই যে আমি অভদ্রতা করে বসেই থাকিব আমাকে এমন অসভ্য মনে করবেন না- বিশেষত পান তামাক এবং পত্নী আপনাদের সভার নিয়মবিরুদ্ধ, অথচ ঐ তিনটে বদ অভ্যাসই আমাকে একেবারে মাটি করেছে, সুতরাং চাটুপটু কাজের কথা সেরেই বাড়িমুখো হতে হবে।” চন্দ্ৰবাবু হাসিয়া কহিলেন, “আপনি যখন সভ্য নন তখন আপনার সম্বন্ধে সভার নিয়ম না-ই খাটালেম- পান-তামাকের বন্দোবস্ত বোধ হয় করে দিতে পারব, কিন্তু আপনার তৃতীয় নেশাই—” অক্ষয় । সেটি এখানে বহন করে আনবার চেষ্টা করবেন না, আমার সে নেশাটি প্ৰকাশ্য নয় ! চন্দ্রবাবু পান-তামাকের জন্য সনাতন চাকরকে ডাকিবার উপক্ৰম করিলেন। পূর্ণ কহিল, “আমি ডাকিয়া দিতেছি।” বলিয়া উঠিল; পাশের ঘরে চাবি এবং চুড়ি এবং সহসা পলায়নের শব্দ একসঙ্গে শোনা গেল । অক্ষয় তাহাকে থামাইয়া কহিলেন, “যস্মিন দেশে যদাচারঃ । যতক্ষণ আমি এখানে আছি ততক্ষণ