পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G 88 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী নিজের শৈথিল্যে যাহার কিছুই মনের মতো হয় না, সর্বদা ভৎসনা করিবার জন্য তাহার একটা হতভাগ্যকে চাই । রসিকদাদা জগত্তারিণীর বহিঃস্থিত আত্মগ্লানিবিশেষ । জগত্তারিণী। আমি তা হলে হারানের বাড়ি চললুম, একেবারে তাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠিব- এর পরে আর যাত্রার সময় নেই। পুরো, তোরা তো দিনক্ষণ মানিস নে, ঠিক সময়ে ইস্টেশনে যাস । তাহার কন্যাজামাতার অসামান্য আসক্তি মা বেশ অবগত ছিলেন। পঞ্জিকার খাতিরে শেষ কিন্তু পুরবালা-যখন বলিল “মা আমি কাশী যাব না”, সেটা তিনি বাড়াবাড়ি মনে করিলেন। পুরবালার প্রতি তাহার বড়ো নির্ভর। সে তাহার সঙ্গে যাইতেছে বলিয়া তিনি নিশ্চিন্ত আছেন। পুরবালা স্বামীর সঙ্গে সিমলা যাতায়াত করিয়া বিদেশভ্রমণে পাকা হইয়াছে ; পুরুষ-অভিভাবকের অপেক্ষা পুরবালাকেই তিনি পথসংকটে সহায়রাপে আশ্রয় করিয়াছেন। হঠাৎ তাহার অসম্মতিতে বিপন্ন হইয়া জগত্তারিণী তাহার জামাতার মুখের দিকে চাহিলেন । অক্ষয় তাহার শাশুড়ির মনের ভাব বুঝিয়া কহিলেন, “ সে কি হয় ? তুমি মার সঙ্গে না গেলে ওঁর অসুবিধা হবে। আচ্ছা মা, তুমি এগোও, আমি ওকে ঠিক সময়ে স্টেশনে নিয়ে যাব।” জগত্তারিণী নিশ্চিন্ত হইয়া প্ৰস্থান করিলেন। রসিকদাদা টাকে হাত বুলাইতে বুলাইতে বিদায়কালীন বিমৰ্ষতা মুখে আনিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন । অক্ষয় | কে মশায় ! আপনি কে ? “আজ্ঞে মশায়, আপনার সহধর্মিণীর সঙ্গে আমার বিশেষ সম্বন্ধ আছে”— বলিয়া পুরুষবেশধারী শৈল অক্ষয়ের সঙ্গে শেক-হ্যান্ড করিল। শৈলী। মুখুজ্যোমশায়, চিনতে তো পারলে না ? পরিবালা | অবাক কারলি ! লাজ করছে না ? শৈল। দিদি, লজা যে স্ত্রীলোকের ভূষণ— পুরুষের বেশ ধরতে গেলেই সেটা পরিত্যাগ করতে হয়। তেমনি আবার মুখুজ্যোমশায় যদি মেয়ে সাজেন, উনি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবেন না। রসিকদাদা, চুপ করে রইলে যে ! রসিক । আহা শৈল ! যেন কিশোর কন্দপ ! যেন সাক্ষাৎ কুমার, ভবানীর কোল থেকে উঠে এল ! ওকে বরাবর শৈল বলে দেখে আসছি, চোখের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল- ও সুন্দরী কি মাঝারি, কি চলনসই, সে কথা কখনো মনেও ওঠে নি— আজি ঐ। বেশটি বদল করেছে বলেই তো ওর রূপাখানি ধরা দিলে! পুরোদিদি, লজার কথা কী বলছিস, আমার ইচ্ছে করছে। ওকে টেনে নিয়ে ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীৰ্ব্বাদ করি । পুরবালা শৈলের তরুণ সুকুমার প্রিয়দর্শন পুরুষমূর্তিতে মনে মনে মুগ্ধ হইতেছিল। গভীর বেদনার সহিত তাহার কেবলই মনে হইতেছিল, আহা শৈল আমাদের বোন না হয়ে যদি ভাই হত । ওর এমন রূপ এমন বুদ্ধি ভগবান সমস্তই ব্যর্থ করে দিলেন!। পুরবালার স্নিগ্ধ চোখ দুইটি ছলছল করিয়া উঠিল। অক্ষয় স্নেহাভিষিক্ত গাম্ভীর্যের সহিত ছদ্মবেশিনীকে ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, সত্যি বলছি শৈল, তুমি যদি আমার শ্যালী না হয়ে আমার ছোটাে ভাই হতে তা হলেও আমি আপত্তি করতুম | | শৈল ঈষৎ বিচলিত হইয়া কহিল, “আমিও করতুম না মুখুজ্যোমশায়।” বাস্তবিক ইহারা দুই ভাইয়ের মতোই ছিল। কেবল সেই ভ্ৰাতৃভাবের সহিত কৌতুকময় বয়স্যভাব পুরবালা শৈলকে বুকের কাছে টানিয়া কহিল, “এই বেশে তুই কুমারসভার সভ্য হতে যাচ্ছিস ?” শৈল। অন্য বেশে হতে গেলে যে ব্যাকরণের দোষ হয় দিদি ! কী বল রসিকদাদা ।