পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G. G. O রবীন্দ্র-রচনাবলী শ্ৰীশ। সন্দেহ জিনিসটা নাস্তিকতার ছায়া। মন্দ হবে, ভেঙে যাবে, নষ্ট হবে, এ-সব ভাব আমি কোনো অবস্থাতেই মনে স্থান দিই নে। ভালোই হবে, যা হচ্ছে বেশ হচ্ছে— চিরকুমার-সভার উদার বিস্তীর্ণ ভবিষ্যৎ আমি চোখের সম্মুখে দেখতে পাচ্ছি— অক্ষয়বাবু সভাকে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে তার কী অনিষ্ট করতে পারেন ? কেবল গলির এক নম্বর থেকে আর-এক নম্বরে নয়, আমাদের যে পথে পথে দেশে দেশে সঞ্চরণ করে বেড়াতে হবে। সন্দেহ শঙ্কা উদবেগ এগুলো মন থেকে দূর করে দাও পূৰ্ণবাবু! বিশ্বাস এবং আনন্দ না হলে বড়ো কাজ হয় না। পূর্ণ নিরুত্তর হইয়া বসিয়া রহিল। বিপিন কহিল, “দিনকতক দেখাই যাক-না, যদি কোনো অসুবিধার কারণ ঘটে তা হলে স্বস্থানে ফিরে আসা যাবে ; আমাদের সেই অন্ধকার বিবরটি ফস করে কেউ কেড়ে নিচ্ছে না।” হায়, পূর্ণের হৃদয়বেদনা কে বুঝিবে ? অকস্মাৎ চন্দ্রমাধববাবুর সবেগে প্রবেশ তিনজনের সসন্ত্রমে উত্থান চন্দ্র। দেখো, আমি সেই কথাটা ভাবছিলুম— শ্ৰীশ। বসুন। চন্দ্ৰ। না না, বসব না, আমি এখনই যাচ্ছি। আমি বলছিলুম, সন্ন্যাসব্রতের জন্যে আমাদের এখন থেকে প্ৰস্তুত হতে হবে। হঠাৎ একটা অপঘাত ঘটলে, কিম্বা সাধারণ জ্বর জালায়, কিরকম চিকিৎসা সে আমাদের শিক্ষা করতে হবে— ডাক্তার রামরতনবাবু ফি। রবিবারে আমাদের দু ঘণ্টা করে বক্তৃতা দেবেন বন্দোবস্ত করে এসেছি। শ্ৰীশ । কিন্তু তাতে অনেক বিলম্ব হবে না ? চন্দ্র। বিলম্ব তো হবেই, কাজটি তো সহজ নয়। কেবল তাই নয়— আমাদের কিছু কিছু আইন অধ্যয়নও দরকার। অবিচার-অত্যাচার থেকে রক্ষা করা, এবং কার কতদূর অধিকার সেটা চাষাভুষোদের বুঝিয়ে দেওয়া আমাদের কাজ । শ্ৰীশ। চন্দ্ৰবাবু, বসুন— চন্দ্ৰ। না শ্ৰীশবাবু, বসতে পারছি নে, আমার একটু কাজ আছে। আর-একটি আমাদের করতে হচ্ছে— গোরুর গাড়ি, টেকি, তাত প্রভৃতি আমাদের দেশী অত্যাবশ্যক জিনিসগুলিকে একটু-আধটু সংশোধন করে যাতে কোনো অংশে তাদের সস্তা বা মজবুত বা বেশি উপযোগী করে তুলতে পারি সে চেষ্টা আমাদের করতে হবে। এবারে গরমির ছুটিতে কেদারবাবুদের কারখানায় গিয়ে প্রত্যহ আমাদের কতকগুলি পরীক্ষা করা চাই । শ্ৰীশ। চন্দ্ৰবাবু, অনেকক্ষণ দাড়িয়ে আছেন— { চৌকি অগ্রসর-করণ চন্দ্ৰ। না, না, আমি এখনই যাচ্ছি। দেখো আমার মত এই যে, এই-সমস্ত গ্রামের ব্যবহার্য সামান্য জিনিসগুলির যদি আমরা কোনো উন্নতি করতে পারি তা হলে তাতে করে চাষীদের মনের মধ্যে যেরকম আন্দোলন হবে, বড়ো বড়ো সংস্কারকাযেও তেমন হবে না। তাদের সেই চিরকেলে র্টেকি-ঘানির কিছু পরিবর্তন করতে পারলে তবে তাদের সমস্ত মন সজাগ হয়ে উঠবে, পৃথিবী যে এক জায়গায় দাড়িয়ে নেই এ তারা বুঝতে পারবে শ্ৰীশ। চন্দ্ৰবাবু, বসবেন না কি ? চন্দ্র। থাক-না। একবার ভেবে দেখো, আমরা যে এতকাল ধরে শিক্ষা পেয়ে আসছি, উচিত ছিল আমাদের টেকি-কুলো থেকে তার পরিচয় আরম্ভ হওয়া। বড়ো বড়ো কলকারখানা তো দূরের কথা, ঘরের মধ্যেই আমাদের সজাগ দৃষ্টি পড়ল না। আমাদের হাতের কাছে যা আছে আমরা না তার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলুম, না তার সম্বন্ধে কিছুমাত্র চিন্তা করলুম। যা ছিল তা তেমনিই রয়ে গেছে। মানুষ অগ্রসর হচ্ছে অথচ তার জিনিসপত্র পিছিয়ে থাকছে, এ কখনো হতেই পারে না। আমরা পড়েই