পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দশম পরিচ্ছেদ পথে বাহির হইয়াই শ্ৰীশ কহিল, “ওহে বিপিন, আজ মাঘের শেষে প্রথম বসন্তের বাতাস দিয়েছে, জ্যোৎস্নাও দিবি, আজ যদি এখনই ঘুমোতে কিংবা পড়া মুখস্থ করতে যাওয়া যায় তা হলে বিপিন। তাদের ধিককার খুব সহজে সহ্য হয়, কিন্তু ব্যামোর ধাক্কা কিংবা— শ্ৰীশ। দেখো, ঐজন্যে তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়। আমি বেশ জানি দক্ষিনে হাওয়ায় তোমারও প্ৰাণটা চঞ্চল হয়, কিন্তু পাছে কেউ তোমাকে কবিত্বের অপবাদ দেয় বলে মলয় সমীরণটাকে একেবারেই আমল দিতে চাও না। এতে তোমার বাহাদুরিটা কী জিজ্ঞাসা করি ? আমি তোমার কাছে আজ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করছি, আমার ফুল ভালো লাগে, জ্যোৎস্না ভালো লাগে, দক্ষিনে হাওয়া ভালো লাগে— বিপিন । এবং— শ্ৰীশ । এবং যা-কিছু ভালো লাগবার মতো জিনিস সবই ভালো লাগে। রিপিন। বিধাতা তো তোমাকে ভারি আশ্চর্য রকম ছাচে গড়েছেন দেখছি। শ্ৰীশ । তোমার ছাচ আরো আশ্চর্য। তোমার ভালো লাগে, কিন্তু বল অন্য রকম— আমার সেই শোবার ঘরের ঘড়িটার মতো— সে চলে ঠিক, কিন্তু বাজে ভুল। বিপিন ; কিন্তু শ্ৰীশ, তোমার যদি সব মনোহর জিনিসই মনোহর লাগতে লাগল তা হলে তো আসন্ন বিপদ । শ্ৰীশ । আমি তো কিছুই বিপদ বোধ করি নে। বিপিন। সেই লক্ষণটাই তো সব চেয়ে খারাপ । রোগের যখন বেদনাবোধ চলে যায়। তখন আর চিকিৎসার রাস্তা থাকে না। আমি, ভাই, স্পষ্টই কবুল করছি। স্ত্রীজাতির একটা আকর্ষণ আছে— চিরকুমার-সভা। যদি সেই আকর্ষণ এড়াতে চান তা হলে তাকে খুব তফাত দিয়ে যেতে হবে। শ্ৰীশ । ভুল, ভুল, ভয়ানক ভুল ! তুমি তফাতে থাকলে কী হবে, তারা তো তফাতে থাকেন না। সংসাররক্ষার জন্যে বিধাতাকে এত নারী সৃষ্টি করতে হয়েছে যে তাদের এড়িয়ে চলা অসম্ভব। অতএব কৌমার্য যদি রক্ষা করতে চাও তা হলে নারীজাতিকে অল্পে অল্পে সইয়ে নিতে হবে। ঐ-যে স্ত্রীসভ্য নেবার নিয়ম হয়েছে, এতদিন পরে কুমারসভা চিরস্থায়ী হবার উপায় অবলম্বন করেছে। কিন্তু কেবল একটিমাত্র মহিলা হলে চলবে না বিপিন, অনেকগুলি স্ত্রীসভ্য চাই। বদ্ধ ঘরের একটি জানলা খুলে ঠাণ্ডা লাগালে সর্দিী ধরে খোলা হাওয়ায় থাকলে সে বিপদ নেই। বিপিন। আমি তোমার ঐ খোলা হাওয়া বদ্ধ হাওয়া বুঝি নে ভাই! যার সর্দির ধাত তাকে সর্দি থেকে রক্ষা করতে দেবতা মনুষ্য কেউ পারে না। শ্ৰীশ । তোমার ধাত কী বলছে হে ? বিপিন। সে কথা খোলসা করে বললেই বুঝতে পারবে তোমার ধাতের সঙ্গে তার চমৎকার মিল আছে। নাড়ীটা যে সব সময়ে ঠিক চিরকুমারের নাড়ীর মতো চলে তা জাক করে বলতে পারব না। শ্ৰাশ। ঐটে তোমার আর-একটা ভুল। চিরকুমারের নাড়ীর উপর উনপঞ্চাশ পাবনের নৃত্য হতে দাও- কোনো ভয় নেই- বাধাবাধি চাপাচাপি কোরো না। আমাদের মতো ব্ৰত যাদের, তারা কি হৃদয়টিকে তুলো দিয়ে মুড়ে রাখতে পারে ? তাকে অশ্বমেধযজ্ঞের ঘোড়ার মতো ছেড়ে দাও, যে তাকে বাধবে তার সঙ্গে লড়াই করো।