পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ8 პა রবীন্দ্র-রচনাবলী “স্বদেশী সমাজ’ শীর্ষক যে প্ৰবন্ধে আমি প্ৰথমে মিনার্ভা ও পরে কর্জন রঙ্গমঞ্চে পাঠ করি, তৎসম্বন্ধে আমার শ্রদ্ধেয় সুহৃৎ শ্ৰীযুক্ত বলাইচাঁদ গোস্বামী মহাশয় কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াছেন । নিজের ব্যক্তিগত কৌতুহল নিবৃত্তির জন্য এ প্রশ্নগুলি তিনি আমার কাছে পাঠান নাই, হিন্দুসমাজনিষ্ঠ ব্যক্তিমাত্রেরই যে যে স্থানে লেশমাত্ৰ সংশয় উপস্থিত হইতে পারে, সেই সেই স্থানে তিনি আমার মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া আন্তরিক কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন । কিন্তু প্রশ্নোত্তরের মতো লিখিতে গেলে লেখা নিতান্তই আদালতের সওয়ালজবাবের মতো হইয়া দাড়ায় । সেরূপ খাপছাড়া লেখায় সকল কথা সুস্পষ্ট হয় না, এইজন্য সংক্ষিপ্ত প্ৰবন্ধ আকারে আমার কথাটা পরিস্ফুট করিবার চেষ্টা করি । কৰ্ণ যখন তাহার সহজ কবচটি ত্যাগ করিয়াছিলেন, তখনই তাহার মৃত্যু ঘনাইয়াছিল ; অর্জন যখন তাহার গাণ্ডীব তুলিতে পারেন নাই, তখনই তিনি সামান্য দসু্যর হাতে পরাস্ত হইয়াছিলেন। ইহা হইতে বুঝা যায়, শক্তি সকলের এক জায়গায় নাই- কোনো দেশ নিজের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে নিজের বল রক্ষা করে, কোনো দেশ নিজের সর্বাঙ্গে শক্তিকবচ ধারণা করিয়া জয়ী হয়। য়ুরোপের যেখানে বল আমাদের সেখানে বল নহে। যুরোপ আত্মরক্ষার জন্য যেখানে উদাম প্রয়োগ করে আমাদের আত্মরক্ষার জন্য সেখানে উদ্যমপ্ৰয়োগ বৃথা। যুরোপের শক্তির ভাণ্ডার স্টেট অর্থাৎ সরকার। সেই স্টেট দেশের সমস্ত হিতকর কর্মের ভার গ্রহণ করিয়াছে- স্টেটই ভিক্ষাদান করে, স্টেটই বিদ্যাদান করে, ধৰ্মরক্ষার ভারও স্টেটের উপর । অতএব এই স্টেটের শাসনকে সর্বপ্রকারে সবল কমিষ্ঠ ও সচেতন করিয়া রাখা, ইহাকে আভ্যন্তরিক বিকলতা ও বাহিরের আক্রমণ হইতে বাচানোই য়ুরোপীয় সভ্যতার প্রাণরক্ষার উপায়। আমাদের দেশে কল্যাণশক্তি সমাজের মধ্যে। তাহা ধৰ্মরূপে আমাদের সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হইয়া আছে। সেইজন্যই এতকাল ধর্মকে সমাজকে বাচানোই ভারতবর্ষ একমাত্র আত্মরক্ষার উপায়। বলিয়া জানিয়া আসিয়াছে। রাজত্বের দিকে তাকায় নাই, সমাজের দিকেই দৃষ্টি রাখিয়াছে। এইজনা সমাজের স্বাধীনতাই যথার্থভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা । কারণ, মঙ্গল করিবার স্বাধীনতাই স্বাধীনতা । ধৰ্মরক্ষার স্বাধীনতাই স্বাধীনতা । এতকাল নানা দুর্বিপাকেও এই স্বাধীনতা অক্ষুন্ন ছিল ; কিন্তু এখন ইহা আমরা অচেতনভাবে। মৃঢ়ভাবে পরের হাতে প্রতিদিন তুলিয়া দিতেছি। ইংরেজ আমাদের রাজত্ব চাহিয়াছিল, রাজত্ব পাইয়াছে, সমাজটাকে নিতান্ত উপরি-পাওনার মতো লেইতেছে--- ফাউ বলিয়া ইহা আমরা তাহার হাতে বিনামূল্যে তুলিয়া দিতেছি । তাহার একটা প্ৰমাণ দেখো । ইংরেজের আইন আমাদের সমাজরক্ষার ভার লইয়াছে । হয়তে{ যথার্থভাবে রক্ষা করিতেছে, কিন্তু তাই বুঝিয়া খুশি থাকিলে চলিবে না। পূর্বকালে সমাজবিদ্রোই। সমাজের কাছে দণ্ড পাইয়া অবশেষে সমাজের সঙ্গে রফা করিত। সেই রফা-অনুসারে আপসে নিষ্পত্তি হইয়া যাইত। তাহার ফল হইত এই সামাজিক কোনো প্রথার ব্যত্যয় যাহারা করিত তাহারা স্বতন্ত্র সম্প্রদােয়রূপে সমাজের বিশেষ একটা স্থানে আশ্রয় লাইত। এ কথা কেহই বলিবেন না, হিন্দুসমাজে আচার বিচারের কোনো পার্থক্য নাই ; পার্থক্য যথেষ্ট আছে, কিন্তু সেই পার্থক্য সামাজিক ব্যবহারগুণে গণ্ডিবদ্ধ হইয়া পরস্পরকে আঘাত করে না । আজ আর তাহা হইবার জো নাই। কোনো অংশে কোনো দল পৃথক হইতে গেলেই হিন্দুসমাজ হইতে তাহাকে ছিন্ন হইতে হয়। পূর্বে এরূপ ছিন্ন হওয়া একটা বিভীষিকা বলিয়া গণ্য হইত। কারণ, তখন সমাজ এরূপ সবল ছিল যে, সমাজকে অগ্রাহা করিয়া টিকিয়া থাকা সহজ ছিল না। সুতরাং যে দল কোনো পার্থক্য অবলম্বন করিত সে উদ্ধতভাবে বাহির হইয়া যাইত না । সমাজ ও নিজের শক্তি সম্বন্ধে নিঃসংশয় ছিল বলিয়াই অবশেষে ঔদার্য প্রকাশ করিয়া পৃথকপন্থাবলম্বীকে যথাযোগ্যভাবে নিজের অঙ্গীভূত করিয়া লইত।