পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ᏔᏯᎶᏑ Ꮸ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী করিতে হয় । বস্তুত, আজ যে পোলিটিকাল প্রসঙ্গ লইয়া এ সভায় উপস্থিত হইয়াছি সেটা হয়তো সম্পূর্ণ ফাকা আওয়াজ, কিন্তু কাল আবার আর-একটা কিছু মারাত্মক ব্যাপার উঠিয়া পড়া আশ্চর্য নহে। ঘড়ি-ঘড়ি এমন কতবার ছুটািছুটি করিতে হইবে ? আজ র্যাহার দ্বারে মাথা খুঁড়িয়া মরিলাম। তিনি সাড়া দিলেন না— অপেক্ষা করিয়া বসিয়া রহিলাম, ইহার মেয়াদ ফুরাইলে যিনি আসিবেন তাহার যদি দয়ামায়া থাকে। তিনি যদি বা দয়া করেন। তবু আশ্বস্ত হইবার জো নাই, আর-এক ব্যক্তি আসিয়া দয়ালুর দান কানে ধরিয়া আদায় করিয়া তাহার হাল-নাগাদ সুন্দসুদ্ধ কাটিয়া লইতে পারেন। এতবড়ো অনিশ্চয়ের উপরে আমাদের সমস্ত আশাভরসা স্থাপন করা যায় ? প্রাকৃতিক নিয়মের উপরে ক্ষোভ চলে না। ‘সনাতন ধর্মশাস্ত্ৰমতে আমার পাখা পোড়ানো উচিত নয়’ বলিয়া পতঙ্গ যদি আগুনে ঝাপ দিয়া পড়ে, তবু তাহার পাখা পুড়িবে। সে স্থলে ধর্মের কথা আওড়াইয়া সময় নষ্ট না করিয়া আগুনকে দূর হইতে নমস্কার করাই তাহার কর্তব্য হইবে। ইংরেজ আমাদিগকে শাসন করিবে, আমাদিগকে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিয়া রাখিতে ইচ্ছা করিবে, যেখানে তাহার শাসনসন্ধি শিথিল হইবার লেশমাত্র আশঙ্কা করিবে, সেইখানেই তৎক্ষণাৎ বলপূর্বক দুটাে পেরেক ঠকিয়া দিবে, ইহা নিতান্তই স্বাভাবিক- পৃথিবীর সর্বত্রই এইরূপ হইয়া আসিতেছে- আমরা সূক্ষ্ম তর্ক করিতে এবং নিখুঁত ইংরেজি বলিতে পারি বলিয়াই যে ইহার অন্যথা হইবে, তা হইবে না। এরূপ স্থলে আর যাই হােক, রাগােরাগি করা চলে না। মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মের উপরে উঠিতে পারে না যে তাহা নহে, কিন্তু সেটাকে প্রাত্যহিক হিসাবের মধ্যে আনিয়া ব্যাবসা করা চলে না। হাতের কাছে একটা দৃষ্টান্ত মনে পড়িতেছে। সেদিন কাগজে পড়িয়াছিলাম, ডাক্তার চন্দ্ৰ খ্রীস্টানমিশনে লাখখানেক টাকা দিবার ব্যবস্থা করিয়াছেন— আইনঘটিত ত্রুটি থাকাতে তাহার মৃত্যুর পরে মিশন সেই টাকা পাওয়ার অধিকার হারাইয়াছিল। কিন্তু ডাক্তার চন্দ্রের হিন্দুভ্ৰাতা আইনের বিরূপতাসত্ত্বেও তাহার ভ্রাতার অভিপ্ৰায় স্মরণ করিয়া এই লাখ টাকা মিশনের হস্তে অৰ্পণ করিয়াছেন। তিনি ভ্ৰাতৃসত্য রক্ষা করিয়াছেন। যদি না যাহা আমার তাহা আমি ছাড়িব না ; এ কথা বলিলে তাহাকে নিন্দা করিবার জো থাকিত না। কারণ, সাধারণত আইন বাচাইয়া চলিলেই সমাজ নীরব থাকে। কিন্তু আইনের উপরেও যে ধর্ম আছে, সেখানে সমাজের কোনো দাবি খাটে না । সেখানে যিনি যান, তিনি নিজের স্বাধীন মহত্ত্বের জোরে যান, মহত্যের গৌরবই। তাই ; তাহার ওজনে সাধারণকে পরিমাণ করা চলে না । ইংরেজ যদি বলিত, জিত দেশের প্রতি বিদেশী বিজেতার যে-সকল সর্বসম্মত অধিকার আছে তাহা আমরা পরিত্যাগ করিব, কারণ, ইহারা বেশ ভালো বাক্ষ্মী- যদি বলিত, বিজিত পরদেশী সম্বন্ধে অল্পসংখ্যক বিজেতা স্বাভাবিক আশঙ্কাবশত যে-সকল সতর্কতার কঠোর ব্যবস্থা করে তাহা আমরা করিব না- যদি বলিত, আমাদের স্বদেশে স্বজাতির কাছে আমাদের গবর্মেন্ট সকল বিষয়ে যেরূপ। খোলসা জবাবদিহি করিতে বাধ্য এখানেও সেরূপ সম্পূর্ণভাবে বাধ্যতা স্বীকার করিব, সেখানে সরকারের কোনো ভ্ৰম হইলে তাহাকে যেরূপ প্ৰকাশ্যে তাহা সংশোধন করিতে হয়। এখানেও সেইরূপ করিতে হইবে, এ দেশ কোনো অংশেই আমাদের নহে, ইহা সম্পূর্ণই এদেশবাসীর, আমরা যেন কেবলমাত্র খবরদারি করিতে আসিয়াছি। এমনিতরো নিরাসক্তভাবে কাজ করিয়া যাইব- তবে আমাদের মতো লোককে ধুলায় লুষ্ঠিত হইয়া বলিতে হইত, তোমরা অত্যন্ত মহৎ, আমরা তোমাদের তুলনায় এত অধম যে, এ দেশে যতকাল তোমাদের পদধূলি পড়িবে ততকাল আমরা ধন্য হইয়া থাকিব । অতএব তোমরা আমাদের হইয়া পাহারা দাও, আমরা নিদ্রা দিই। ; তোমরা আমাদের হইয়া মূলধন খাটাও এবং তাহার লাভটা আমাদের তহবিলে জমা হইতে থােক ; আমরা মুড়ি খাই তোমরা চাহিয়া দেখো, অথবা তোমরা চাহিয়া দেখো আমরা মুড়ি খাইতে থাকি। কিন্তু ইংরেজ এত মহৎ নয় বলিয়া আমাদের পক্ষে অত্যন্ত বিচলিত হওয়া শোভা পায় না, বরঞ্চ কৃতজ্ঞ হওয়াই উচিত। দূরব্যাপী