পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মশক্তি \(\چه ه তাহাই নিরূপণ করিবার জন্য দেশবিদেশের বিজ্ঞান দর্শন ও ধর্ম শাস্ত্ৰ পড়িয়া তিনি কুলকিনারা পাইতেছেন না, তবে তাহাকে এই অত্যন্ত সহজ কথাটি যত্ন করিয়া বুঝাইতে হয়— আগে দেখো তোমার ছেলেটা কোথায় আছে, কী করিতেছে, সে পাতকুয়ায় পড়িল কি আলপিন গিলিয়া বসিল, তাহার ক্ষুধা পাইয়াছে কি শীত করিতেছে। এ-সব সাধারণত বলিতেই হয় না, কিন্তু যদি দুৰ্দৈবক্রমে বিশেষ স্থলে বলা আবশ্যক হইয়া পড়ে, তবে বাহুল্য করিয়াই বলিতে হয়। বর্তমান কালে আমাদের দেশে যদি বলা যায় যে, দেশের জন্য বক্তৃতা করো, সভা করো, তর্ক করো, তবে তাহা সকলে অতি সহজেই বুঝিতে পারেন ; কিন্তু যদি বলা হয়, দেশকে জানো ও তাহার পরে স্বহস্তে যথাসাধ্য দেশের সেবা করো, তবে দেখিয়াছি, অর্থ বুঝিতে লোকের বিশেষ কষ্ট হয়। এমন অবস্থায় দেশের প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে দুটাে-একটা সামান্য কথা বলিতে যদি অসামান্য বাক্যব্যয় করিয়া থাকি, তবে মার্জনা করিতে হইবে। বস্তুত, সকালবেলায় যদি ঘন কুয়াশা হইয়া থাকে। তবে অধীর হইয়া ফল নাই এবং হতাশ হইবারও প্রয়োজন দেখি না— সূর্য সে কুয়াশা ভেদ করিবেনই এবং করিবামাত্র সমস্ত পরিষ্কার হইয়া যাইবে । আজ আমি অধীরভাবে অধিক আকাঙক্ষা করিব না— অবিচলিত আশার সহিত আনন্দের সহিত এই কথাই বলিব, নিবিড় কুজ্বাটিকার মাঝে মাঝে ঐ-যে বিচ্ছেদ দেখা যাইতেছে- সূর্যরশ্মির ছটা খরধার কৃপাণের মতো আমাদের দৃষ্টির আবরণ তিন-চারি জায়গায় ভেদ করিয়াছে— আর ভয় নাই, গৃহদ্বারের সম্মুখেই আমাদের যাত্রাপথ অনতিবিলম্বেই পরিস্ফুটিরূপে প্রকাশিত হইয়া পড়িবে— তখন দিগবিদিক সম্বন্ধে দশজন মিলিয়া দশপ্রকারের মত লইয়া ঘরে বসিয়া বাদ-বিতণ্ডা করিতে হইবে না— তখন সকলে আপনি-আপিন শক্তি অনুসারে আপনি-আপিন পথ নির্বাচন করিয়া তর্কসভা হইতে, পুঁথির রুদ্ধ কক্ষ হইতে বাহির হইয়া পড়িব— তখন নিকটের কাজকে দূর মনে হইবে না এবং অত্যাবশ্যক কাজকে ক্ষুদ্র বলিয়া অবজ্ঞা জন্মিবে না। এই শুভক্ষণ আসিবে বলিয়া আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস আছে- সেইজন্য, পরিষদের আদ্যকার আহবান যদি তোমাদের অন্তরে স্থান না পায়, বাংলাদেশের ঘরের কথা জানাকে যদি তোমরা বেশি একটা কিছু বলিয়া না মনে কর— তবু আমি ক্ষুব্ধ হইব না এবং আমার যে মাতৃভূমি এতদিন তাহার সন্তানগণের গৃহপ্ৰত্যাগমনের জন্য ইস্কুলের ছুটি হইয়াছে, সভা ভাঙিয়াছে, এইবার তোমার কুটিরপ্রাঙ্গণের অভিমুখে তোমার ক্ষুধিত সন্তানদের পদধবনি ঐ শোনা যাইতেছে- এখন বাজাও তোমার শঙ্খ, জ্বালো তোমার প্রদীপ, তোমার আশীর্বাচনের দ্বারা সার্থক করিবার জন্য প্ৰস্তুত হইয়া থাকো । বৈশাখ ১৩, ১২ য়ুনিভার্সিটি বিল এতকাল ধরিয়া য়ুনিভার্সিটি বিলের বিধিবিধান লইয়া তন্ন তন্ন করিয়া অনেক আলোচনা হইয়া গেছে, সেগুলির পুনরুক্তি বিরক্তিকর হইবে । মোটামুটি দুই-একটা কথা বলিতে চাই । টাকা থাকিলে, ক্ষমতা থাকিলে, সমস্ত অবস্থা অনুকূল হইলে, বন্দোবস্তর চূড়ান্ত করা যাইতে পারে সে কথা সকলেই জানে। কিন্তু অবস্থার প্রতি তাকাইয়া দুরাশাকে খর্ব করিতে হয়। লর্ড কার্জন বিলাতের সব ভালো আমাদিগকে দিবার কোনো বন্দোবস্ত করেন নাই, মাঝে হইতে কেবল একটা ভালোই মানাইবে কেন ? প্ৰত্যেকের সাধ্যমত যে ভালো সে-ই তাহার সর্বোত্তম ভালো, তাহার চেয়ে ভালো আর হইতে পারে না— অন্যের ভালোর প্রতি লোভ করা বৃথা ।