পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

とがbrbr রবীন্দ্র-রচনাবলী রাষ্ট্ৰচালনায় কিছু-না-কিছু অধিকারী, এইজন্য তাহারা বড়ো, সেইগুলি নাই বলিয়াই আমরা ছোটাে, তবে গোড়ার কথাটা বলা হয় না। আমরা কোনো কৌতুকপ্ৰিয় দেবতার বরে যদি কয়েক দিনের জন্য মূঢ় আবুহােসেনের মতো ইংরেজি মােহাস্ত্ৰ্যের বাহ্য অধিকারী হই, আমাদের বন্দরে বাণিজ্যতরীর আবির্ভাব হয়, পার্লামেন্টের গৃহচূড়া আকাশ ভেদ করিয়া উঠে, তবে প্রথম অঙ্কের প্রহসন পঞ্চম অঙ্কে কী মৰ্মভেদী অশ্রুপাতেই অবসিত হয় ! আমরা এ কথা যেন কোনোমতেই না মনে করি যে পার্লামেন্ট মানুষ গড়ে— বস্তুত মানুষই পার্লামেন্ট গড়ে। মাটি সর্বত্রই সমান ; সেই মাটি লইয়া কেহ বা শিব গড়ে, কেহ বা বানর গড়ে ; যদি কিছু পরিবর্তন করিতে হয় তবে মাটির পরিবর্তন নহে— যে ব্যক্তি গড়ে তাহার শিক্ষা ও সাধনা, চেষ্টা ও চিন্তার পরিবর্তন করিতে হইবে । এই ত্রিপুররাজ্যের রাজচিহ্নের মধ্যে একটি সংস্কৃতবাক্য অঙ্কিত দেখিয়াছি— ‘কিল বিদুবীরতাং সারমেকং’- বীর্যকেই সার বলিয়া জানিবে। এই কথাটি সম্পূৰ্ণ সত্য। পার্লামেন্ট সারা নহে, বাণিজ্যতরী সারা নহে, বীর্যই সার। এই বীর্য দেশকলপাত্রভেদে নানা আকারে প্রকাশিত হয়— কেহ বা শস্ত্রে বীর, কেহ বা শাস্ত্রে বীর, কেহ বা ত্যাগে বীর, কেহ বা ভোগে বীর, কেহ বা ধর্মে বীর, কেহ বা কর্মে বীর। বর্তমানে আমাদের ভারতবর্ষীয় প্রতিভাকে আমরা পূর্ণ উৎকর্ষের দিকে লইয়া যাইতে পারিতেছি না। তাহার কতকগুলি কারণ আছে, কিন্তু সর্বপ্ৰধান কারণ বীর্যের অভাব। এই বীর্যের দারিদ্র্যবশত যদি নিজের প্রকৃতিকেই ব্যর্থ করিয়া থাকি তবে বিদেশের অনুকৃতিতে সার্থক করিয়া তুলিব কিসের জোরে ? আমাদের আমবাগানে আজকাল আমি ফলে না, বিলাতের আপেলাবাগানে প্রচুর আপেল ফলিয়া থাকে। আমরা কি তাই বলিয়া মনে করিব যে, আমগাছগুলা কাটিয়া ফেলিয়া আপেলগাছ রোপণ করিলে তবেই আমরা আশানুরূপ ফললাভ কবিব। এই কথা নিশ্চয় জানিতে হইবে, আপেলগাছে যে বেশি ফল ফলিতেছে তাহার কারণ তাহার গোড়ায়, তাহার মাটিতে সারা আছে— আমাদের আমবাগানের জমির সাের বহুকাল হইল নিঃশেষিত হইয়া গেছে। আপেল পাই না ইহাই আমাদের মূল দুৰ্ভাগ্য নহে, মাটিতে সারা নাই। ইহাই আক্ষেপের বিষয় । সেই সার যদি যথেষ্ট পরিমাণে থাকিত তবে আপেল ফলিত না, কিন্তু আমি প্রচুর পরিমাণে ফলিত এবং তখন সেই আস্রের সফলতায় আপেলের অভাব লইয়া বিলাপ করিবার কথা আমাদের মনেই হইত না । তখন দেশের আম বেচিয়া অনায়াসে বিদেশের আপেল হাটে কিনিতে পারিতাম, ভিক্ষার ঝুলি সম্বল করিয়া এক রাত্রে পরের প্রসাদে বড়োলোক হইবার দুরাশা মনের মধ্যে বহন করিতে হইত না । আসল কথা, দেশের মাটিতে সার ফেলিতে হইবে। সেই সার আর-কিছুই নহে— “কিল বিদুবীরতাং সারমেকং, বীরতাকেই একমাত্র সার বলিয়া জানিবে। ঋষিরা বলিয়াছেন : নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ । এই – যে আত্মা, ইনি বলহীনের দ্বারা লভ্য নহেন। বিশ্বাত্মা-পরমাত্মার কথা ছাড়িয়া দেওয়া যাক— যে ব্যক্তি দুর্বল সে নিজের আত্মাকে পায় না, নিজের আত্মাকে যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ উপলব্ধি না করিয়াছে সে অপর কিছুকেই লাভ করিতে পারে না। যুরোপ নিজের আত্মাকে যে পথ দিয়া লাভ করিতেছে সে পথ আমাদের সম্মুখে নাই ; কিন্তু যে মূল্য দিয়া লাভ করিতেছে তাহা আমাদের পক্ষেও অত্যাবশ্যক- তাহা বল, তাহা বীৰ্য । যুরোপ যে কর্মের দ্বারা যে অবস্থার মধ্যে আত্মাকে উপলব্ধি করিতেছে আমরা সে কর্মের দ্বারা সে অবস্থার মধ্যে আত্মাকে উপলব্ধি করিব না— আমাদের সম্মুখে অন্য পথ, আমাদের চতুর্দিকে অন্যরূপ পরিবেশ, আমাদের অতীতের ইতিহাস অন্যরূপ, আমাদের শক্তির মূলসঞ্চয় অন্যত্ৰ— কিন্তু আমাদের সেই বীৰ্য আবশ্যক যাহা থাকিলে পথকে ব্যবহার করিতে পারিব, পরিবেশকে অনুকুল করিতে পারিব, অতীতের ইতিহাসকে বর্তমানে সফল করিতে পারিব এবং শক্তির গৃঢ় সঞ্চয়কে আবিষ্কৃত উদঘাটিত করিয়া তাহার অধিকারী হইতে পারিব । ‘নায়মাত্মা বলহীনের লভ্যঃ”— আত্মা তো আছেই, কিন্তু বল নাই বলিয়া তাহাকে লাভ করিতে পারি না ! ত্যাগ করিতে শক্তি নাই, দুঃখ পাইতে সাহস নাই, লক্ষ্য অনুসরণ করিতে নিষ্ঠা নাই ; কৃশ সংকল্পের দৌর্বল্য, ক্ষীণ শক্তির আত্মবঞ্চনা, সুখবিলাসের ভীরুতা, লোকলজা, লোকভয়