পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ՕՀ রবীন্দ্র-রচনাবলী সীমা থাকে না । আমাদের দেশে স্বস্থানের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সকলেই আপনার নিশ্চিত অধিকারটুকু মর্যাদা ও শান্তি লাভ করে বলিয়াই, ছোটাে সুযোগ পাইলেই বড়োকে খেদাইয়া যায় না, এবং বড়োও ছােটােকে সর্বদা সর্বপ্রযত্নে খেদাইয়া রাখে না । যুরোপ বলে, এই সন্তোষই, এই জিগীষার অভাবই, জাতির মৃত্যুর কারণ । তাহা যুরোপীয় সভ্যতার মৃত্যুর কারণ বটে, কিন্তু আমাদের সভ্যতার তাঁহাই ভিত্তি । যে লোক জাহাজে আছে তাহার পক্ষে যে বিধান, যে লোক ঘরে আছে তাহারও পক্ষে সেই বিধান নহে । যুরোপ যদি বলে সভ্যতামাত্রেই সমান এবং সেই বৈচিত্র্যহীন সভ্যতার আদর্শ কেবল যুরোপেই আছে, তবে তাহার সেই স্পর্ধাবাক্য শুনিয়াই তাড়াতাড়ি আমাদের ধনরত্নকে ভাঙা কুলা দিয়া পথের মধ্যে বাহির করিয়া ফেলা সংগত হয় না । বস্তুত সন্তোষের বিকৃতি আছে বলিয়াই অত্যাকাঙক্ষার যে বিকৃতি নাই, এ কথা কে মানিবে ? সন্তোষে জড়ত্ব প্ৰাপ্ত হইলে কাজে শৈথিল আনে ইহা যদি সত্য হয়, তবে অত্যাকাঙক্ষার দম বাডিয়া গেলে যে ভূরি-ভুরি অনাবশ্যক ও নিদারুণ অকাজের সৃষ্টি হইতে থাকে এ কথা কেন ভুলিব ? প্রথমটাতে যদি রোগে মৃত্যু ঘটে, তবে দ্বিতীয়টাতে অপঘাতে মৃত্যু ঘটিয়া থাকে । এ কথা মনে রাখা কর্তব্য, সন্তোষ এবং আকাঙক্ষা দুয়েরই মাত্ৰা বাড়িয়া গেলে বিনাশের কারণ জন্মে । অতএব সে আলোচনা ছাড়িয়া দিয়া ইহা স্বীকার করিতেই হইবে, সন্তোষ, সংযম, শান্তি, ক্ষমা, এ-সমস্তই উচ্চতর সভ্যতার অঙ্গ । ইহাতে প্ৰতিযোগিতা-চকমকির ঠোকাঠুকি-শব্দ ও স্মৃলিঙ্গবর্ষণ নাই, কিন্তু হীরকের স্নিগ্ধ নিঃশব্দ জ্যোতি আছে। সেই শব্দ ও স্মৃলিঙ্গকে এই ধ্ৰুবজ্যোতির চেয়ে মূল্যবান মনে করা বর্বরতা মাত্র । যুরোপীয় সভ্যতার বিদ্যালয় হইতেও যদি সে বর্বরতা প্রসূত হয়, তবু তাহা বর্বরতা । আমাদের প্রকৃতির নিভৃততম কক্ষে যে অমর ভারতবর্ষ বিরাজ করিতেছেন, আজ নববর্ষের দিনে তাহাকে প্ৰণাম করিয়া আসিলাম । দেখিলাম, তিনি ফললোলুপ কর্মের অনন্ত তাড়না হইতে মুক্ত হইয়া শান্তির ধ্যানাসনে বিরাজমান, অবিরাম জনতার জড়পোষণ হইতে মুক্ত হইয়া আপন একাকিত্বের মধ্যে আসীন, এবং প্রতিযোগিতার নিবিড় সংঘর্ষ ও ঈর্ষাকালিমা হইতে মুক্ত হইয়া তিনি আপন অবিচলিত মর্যাদার মধ্যে পরিবেষ্টিত । এই—যে কর্মের বাসনা, জনসংঘের আঘাত ও জিগীষার উত্তেজনা হইতে মুক্তি, ইহাই সমস্ত ভারতবর্ষকে ব্ৰহ্মের পথে ভয়হীন শোকহীন মৃত্যুহীন পরম মুক্তির পথে স্থাপিত করিয়াছে। যুরোপে যাহাকে ‘ফ্রীডম” বলে সে মুক্তি ইহার কাছে নিতান্তই ক্ষীণ । সে মুক্তি চঞ্চল, দুর্বল, ভীরু ; তাহা স্পর্ধিত, তাহা নিষ্ঠুর ; তাহা পরের প্রতি অন্ধ, তাহা ধর্মকেও নিজের সমতুল্য মনে করে না এবং সত্যকেও নিজের দাসত্বে বিকৃত করিতে চাহে । তাহা কেবলই অন্যকে আঘাত করে, এইজন্য অন্যের আঘাতের ভয়ে রাত্ৰিদিন বমে-চমে অস্ত্ৰে-শস্ত্রে কণ্টকিত হইয়া বসিয়া থাকে, তাহা আত্মরক্ষার জন্য স্বপক্ষের অধিকাংশ লোককেই দাসত্বনিগড়ে বদ্ধ করিয়া রাখে- তাহার অসংখ্য সৈন্য মনুষ্যত্বভ্ৰষ্ট ভীষণ যন্ত্রমাত্র । এই দানবীয় ফ্রীডম কোনোকালে ভারতবর্ষের তপস্যার চরম বিষয় ছিল না— কারণ, আমাদের জনসাধারণ অন্য সকল দেশের চেয়ে যথার্থভাবে স্বাধীনতার ছিল । এখনো আধুনিক কালের ধিককারসত্ত্বেও এই ফ্রীডম আমাদের সর্বসাধারণের চেষ্টার চরমতম লক্ষ্য হইবে না | নাই হইল— এই ফ্রীডমের চেয়ে উন্নততর বিশালতার যে মহত্ত্ব, যে মুক্তি ভারতবর্ষের তপস্যার ধন, তাহা যদি পুনরায় সমাজের মধ্যে আমরা আবাহন করিয়া আনি, অন্তরের মধ্যে আমরা লাভ করি, তবে ভারতবর্ষের নগ্নচরণের ধূলিপাতে পৃথিবীর বড়ো বড়ো রাজমুকুট পবিত্ৰ হইবে । এইখানেই নববর্ষের চিন্তা আমি সমাপ্ত করিলাম । আজ পুরাতনের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলাম, কারণ পুরাতনই চীরনবীনতার অক্ষয় ভাণ্ডার । আজ যে নবকিশলয়ে বনলক্ষ্মী উৎসববস্ত্র পরিয়াছেন এ বস্ত্ৰখানি আজিকার নহে, যে ঋষি কবিরা ত্ৰিষ্টুভছন্দে তরুণী উষার বন্দনা করিয়াছেন তাহারাও এই মসৃণ চিক্কণ পীতহরিৎ বসনখানিতে বনশ্ৰীকে অকস্মাৎ সাজিতে দেখিয়াছেন— উজ্জয়িনীর পুরোদানে কালিদাসের মুগ্ধদৃষ্টির সম্মুখে এই সমীরকম্পিত কুসুমগন্ধি অঞ্চলপ্ৰান্তটি নবসূৰ্য্য করে ঝলমল