পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

് ভারতবর্ষ। Q S\లి তোমাদের কারবারের সর্বত্রই তোমরা ব্যক্তির জায়গায় কোম্পানি এবং মজুরের জায়গায় কল বসাইতেছ। মুনাফার চেষ্টাতেই সকলে ব্যস্ত— শ্রমজীবীর মঙ্গলের ভার কাহারোই নহে, সেটা সরকারের। সরকার সেটাকে সামলাইয়া উঠিতে পারে না। সহস্ৰ ক্রোশ দূরে যদি দুর্ভিক্ষ হয়, যদি কোথাও মাশুলের কোনো পরিবর্তন হয়, তবে তোমাদের লক্ষ লোকের কারবার বিশ্লিষ্ট হইবার জো হয়- যাহার উপরে তোমাদের হাত নাই তাহার উপরে তোমাদিগকে নির্ভর করিতে হয়। তোমাদের মূলধন একটা সজীব পদার্থ, সেটা খোরাকের জন্য সর্বদাই চীৎকার করিতেছে ; তাহাকে আহার না জোগাইলে সে তোমাদের গলা চাপিয়া ধরে। তোমরা যে উৎপন্ন কর সেটা ইচ্ছামত নহে, সেটা অগত্যা— এবং তোমরা যে কিনিয়া থাক সেটা যে চাও বলিয়া তাহা নহে, সেটা তোমাদের ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়ে বলিয়া। এই-যে বাণিজ্যটাকে তোমরা মুক্ত বলো, ইহার মতো বদ্ধ বাণিজ্য আর নাই। কিন্তু ইহা কোনো বিবেচনাসংগত ইচ্ছার দ্বারা বদ্ধ নহে, ইহা আকস্মিক খেয়ালের স্তৃপকার মূঢ়তার দ্বারা বন্দীকৃত। ‘চীনেম্যানের চক্ষে তোমাদের দেশের ভিতরকার আর্থিক অবস্থা এইরকমই ঠেকে। পররাষ্ট্রের সহিত তোমাদের বাণিজ্যসম্বন্ধ, সেও অত্যন্ত উল্লাসজনক নয়। পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে ধারণা হইয়াছিল যে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে যখন বাণিজ্যসম্বন্ধ স্থাপিত হইবে তখন শান্তির সত্যযুগ আসিবে। কাজে দেখা গেল সমস্তই উলটা। প্ৰাচীনকালের রাজাদের অত্যাকাঙক্ষা ও ধর্মযাজকদের গোড়ামির চেয়ে এই বাণিজ্য-স্থান লইয়া পরস্পর টানাটানিতে যুদ্ধবিগ্রহের সম্ভাবনা আরো বেশি প্রবল হইয়া উঠিতেছে। পৃথিবীর যেখানেই একটুখানি অপরিচিত স্থান ছিল, সেইখানেই যুরোপের লোক একেবারে ক্ষুধিত হিংস্ৰ জন্তুর মতো হুংকার দিয়া পড়িতেছে। এখন যুরোপের এলাকার সীমানার বাহিরে এই লুণ্ঠনব্যাপার চলিতেছে। কিন্তু যতক্ষণ ভাগাভাগি চলিতেছে ততক্ষণ পরস্পরের প্রতি পরস্পর কট্রমট করিয়া তাকাইতেছে। আজ হউক বা কাল হউক, যখন আর বঁাটােয়ারা করিবার জন্য কিছুই বাকি থাকিবে না, তখন তাহারা পরস্পরের ঘাড়ের উপরে গিয়া পড়িবে। তোমাদের শাস্ত্রসজার এই আসল তাৎপৰ্য- হয় তোমরা অন্যকে গ্ৰাস করিবে, নয় অন্যে তোমাদিগকে গ্ৰাস করিবে। যে কাটাকাটির প্রতিযোগী করিয়া তুলিয়াছে এবং তোমাদের সকলকে একটা বিরাট বিনাশব্যাপারের অনতিদূরে আনিয়া স্থাপন করিয়াছে।” লেখক বলেন ‘পরিশ্রম বঁাচাইবার কল তৈরি করিতে তোমরা যে বুদ্ধি খাটাইতেছ। তাহাতে সমাজের কল্যাণ হইতেছে না। তাহাতে ধনবৃদ্ধি হইতেছে সন্দেহ নাই, কিন্তু সেটা যে মঙ্গলই আমার মতে এমন কথা মনে করিবার হেতু নাই। ধন কিরূপে ভাগ হয় এবং সেই ধনে জাতির চরিত্রের উপরে কী ফল হয়, তাহাই চিন্তার বিষয়। সেইটে যখন চিন্তা করি তখন বিলাতি পদ্ধতি চীনে ঢুকাইবার প্রস্তাবে মন বিগড়াইয়া যায়। শ্রমজীবী দিগকে সংকটে ফেলিয়া তাহা হইতে উদ্ধারের কোনো একটা ভালো উপায় বাহির করা নাই। ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে; কারণ টাকা করা তোমাদের প্রধান লক্ষ্য, জীবনের আর-সমস্ত লক্ষ্য তাহার নীচে। চীনেম্যানের কাছে এটা কিছুতেই উৎসাহজনক ঠেকে না। বিলাতি কারবারের প্রণালী যদি চীনদেশে ফালাও করিয়া তোলা যায়। তবে তাহার চল্লিশ কোটি অধিবাসীর মধ্যে যে নিশ্চিত বিশঙ্খলা জাগিয়া উঠিবে, অন্তত আমি তো তাহাকে অত্যন্ত আশঙ্কার চক্ষে দেখি। তোমরা বলিবে, সে বিশৃঙ্খলা সাময়িক । আমি তো দেখিতেছি, তোমাদের দেশে তাহা চিরস্থায়ী। আচ্ছা, সে কথাও যাক, তাহাতে আমাদের লাভটা কী ? আমরা তো তোমাদেরই মতো হইয়া যাইব ! সে সম্ভাবনা কি অবিচলিতচিত্তে কল্পনা করা যায় ? তোমাদের লোকেরা নাহয় আমাদের চেয়ে আরামে খায় বেশি, পান করে বেশি, নিদ্রা যায় বেশি।— কিন্তু তাহারা প্ৰফুল্ল নয়, সন্তুষ্ট নয়, শ্রমানুরাগী নয়, তাহারা আইন মানে না।