পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

محے ভারতবর্ষ। Գ8 (շ পোশাকের প্রান্ত শিখ ও রাজপুত রাজকুমারদের দ্বারা বহন করাইয়া লইলেন, আকস্মিক উপদ্রবের মতো একদিন একটা সমারোহের আগ্নেয় উচ্ছাস উদগীরিত হইয়া উঠিল— তাহার পর সমস্ত শূন্য, সমস্ত নিম্প্রভ । এখনকার ভারতসাম্রাজ্য আপিসে এবং আইনে চলে— তাহার রঙচঙে নাই, গীতবাদ্য নাই, তাহাতে প্ৰত্যক্ষ মানুষ নাই। ইংরেজের খেলাধুলা, নাচগান, আমোদ-প্ৰমোদ সমস্ত নিজেদের মধ্যে বদ্ধ— সে আনন্দ-উৎসবের উদ্যবৃত্ত খুদকুড়াও ভারতবর্ষের জনসাধারণের জন্য প্রমোদশালার বাহিরে আসিয়া পড়ে না। আমাদের সঙ্গে ইংরেজের সম্বন্ধ আপিসের বাধা কাজ এবং হিসাবের খাতা-সাহির সম্বন্ধ। প্ৰাচ্য সম্রাটের ও নবাবের সঙ্গে আমাদের অন্নবস্ত্ৰ শিল্পশোভা আনন্দ-উৎসবের নানা সম্বন্ধ ছিল। তাহাদের প্রাসাদে প্রমোদের দীপ জ্বলিলে তাহার আলোক চারি দিকে প্রজার ঘরে ছড়াইয়া পড়িত— তাহাদের তোরণদ্বারে যে নহবত বসিত তাহার আনন্দধ্বনি দীনের কুটিরের মধ্যেও প্ৰতিধ্বনিত হইয়া উঠিত । ইংরেজ সিভিলিয়ানগণ পরস্পরের আমন্ত্রণে নিমন্ত্রণে সামাজিকতায় যোগদান করিতে বাধ্য, যে ব্যক্তি স্বভাবদোষে এই-সকল বিনোদনব্যাপারে অপটু তাহার উন্নতির অনেক ব্যাঘাত ঘটে। এই সমস্তই নিজেদের জন্য । যেখানে পাচটা ইংরেজ আছে সেখানে আমোদ-আহলাদের অভাব নাই ; কিন্তু সে আমোদে চারি দিক আমোদিত হইয়া উঠে না। আমরা কেবল দেখিতে পাই—— কুলিগুলা বাহিরে বসিয়া সস্ত্ৰস্তচিত্তে পাখার দড়ি টানিতেছে, সহিস ডগাকার্টের ঘোড়ার লাগাম ধরিয়া চামর দিয়া, মশামাছি তাড়াইতেছে, এবং দগ্ধ ভারতবর্ষের তপ্ত সংস্রব হইতে সুদূরে যাইবার জন্য রাজপুরুষগণ সিমলার শৈলশিখরে উর্ধবশ্বাসে ছুটিয়া চলিয়াছেন। মৃগয়ার সময় বাজে লোকেরা জঙ্গলের শিকার তাড়া করিতেছে এবং বন্দুকের দুটাে-একটা গুলি পশুলক্ষ্য হইতে ভ্ৰষ্ট হইয়া নেটিভের মর্মভেদ করিতেছে। ভারতবর্ষে ইংরেজরাজ্যের বিপুল শাসনকার্য একেবারে আনন্দইন, সৌন্দর্যহীন— তাহার সমস্ত পথই আপিস-আদালতের দিকে- জনসমাজের হৃদয়ের দিকে নহে। হঠাৎ ইহার মধ্যে একটা খাপছাড়া দরবার কেন ? সমস্ত শাসনপ্রণালীর সঙ্গে তাহার কোনখানে যোগ ? গাছে লতায় ফুল ধরে, আপিসের কড়িবারগায় তো মাধবীমঞ্জরী ফোটে না। এ যেন মরুভূমির মধ্যে মরীচিকার মতো। এ ছায়া তাপনিবারণের জন্য নহে, এ জল তৃষ্ণা দূর করিবে না। পূর্বেকার দরবারে সম্রাটেরা যে নিজের প্রতাপ জাহির করিতেন তাঁহা নহে। সে-সকল দরবার কাহারও কাছে তারস্বরে কিছু প্ৰমাণ করিবার জন্য ছিল না ; তাহা স্বাভাবিক। সে-সকল উৎসব বাদশাহ-নবাবদের ঔদার্যের উদবেলিত প্ৰবাহ-স্বরূপ ছিল, সেই প্রবাহ বদ্যান্যতা বহন করিত, তাহাতে প্রার্থীর প্রার্থনা পূর্ণ করিত, দীনের অভাব দূর হইত, তাহাতে আশা এবং আনন্দ দূরদূরান্তরে বিকীর্ণ হইয়া যাইত। আগামী দরবার উপলক্ষে কোন পীড়িত আশ্বস্ত হইয়াছে, কোন দরিদ্র সুখস্বপ্ন দেখিতেছে ? সেদিন যদি কোনো দুরাশাগ্ৰস্ত দুৰ্ভাগা দরখাস্ত হাতে সম্রাটপ্রতিনিধির কাছে অগ্রসর হইতে চায়, তবে কি পুলিসের প্রহার পৃষ্ঠে লইয়া তাহাকে কাদিয়া ফিরিতে হইবে না ? তাই বলিতেছিলাম, আগামী দিল্লির দরবার পাশ্চাত্য অত্যুক্তি, তাহা মেকি অত্যুক্তি। এ দিকে হিসাবকিতাব এবং দোকানদারিটুকু আছে- ও দিকে প্রাচ্যসম্রাটের নকলটুকু না করিলে নয়। আমরা দেশব্যাপী অনশনের দিনে এই নিতান্ত ভূয়া দরবারের আড়ম্বর দেখিয়া ভীত হইয়াছিলাম বলিয়া কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়া বলিয়াছেন— খরচ খুব বেশি হইবে না, যাহাও হইবে তাহার অর্ধেক আদায় করিয়া লইতে পারিব। কিন্তু সেদিন উৎসব করা চলে না যেদিন খরচপত্র সামলাইয়া চলিতে হয়। তহবিলের টানাটানি লইয়া উৎসব করিতে হইলে, নিজের খরচ বঁাচাইবার দিকে দৃষ্টি রাখিয়া অন্যের খরচের প্রতি উদাসীন হইতে হয়। তাই আগামী দরবারে সম্রাটের নায়েব অল্প খরচে কাজ চালাইবেন। অন্তত কটা হাতি, কটা ঘোড়া, কজন লোক আনিতে হইবে, শুনিতেছি তাহার অনুশাসন জারি হইয়াছে। সেই সকল রাজাদেরই হাতিঘোড়া-লোকলস্করে যথাসম্ভব অল্প খরচে চতুর সম্রাটপ্রতিনিধি