পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চরিত্ৰপূজা Գ ՆՏ অসামান্য অনন্যতন্ত্রত্ব প্রকাশ করিয়াছেন তাহা বাংলার ইতিহাসে আতিশয় বিরল। এত বিরল যে, এক শতাব্দীর মধ্যে কেবল আর দুই-একজনের নাম মনে পড়ে এবং তাঁহাদের মধ্যে রামমোহন রায় সর্বশ্রেষ্ঠ । অনন্যতন্ত্রতা শব্দটা শুনিবা মাত্র তাহাকে সংকীর্ণতা বলিয়া ভ্ৰম হইতে পারে ; মনে হইতে পারে, তাহা ব্যক্তিগত বিশেষত্ব, সাধারণের সহিত তাহার যোগ নাই। কিন্তু সে কথা যথার্থ নহে। বস্তুত আমরা নিয়মের শঙ্খলে, জটিল কৃত্রিমতার বন্ধনে এতই জড়িত ও আচ্ছন্ন হইয়া থাকি যে, আমরা সমাজের কল-চালিত পুত্তলের মতো হইয়া যাই ; অধিকাংশ কাজই সংস্কারাধীনে অন্ধভাবে সম্পন্ন করি ; নিজত্ব কাহাকে বলে জানি না, জানিবার আবশ্যকতা রাখি না। আমাদের ভিতরকার আসল মানুষটি জন্মাবধি মৃত্যুকাল পর্যন্ত প্ৰায় সুপ্তভাবেই কাটাইয়া দেয়, তাহার স্থানে কাজ করে একটা নিয়ম-বাধা যন্ত্র। র্যাহাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের পরিমাণ অধিক, চিরাগত প্রথা ও অভ্যাসের জড় আচ্ছাদনে তাহাদের সেই প্রবল শক্তিকে চাপা দিয়া রাখিতে পারে না। ইহারাই নিজের চরিত্রপুরীর মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রাপ্ত হন। অন্তরস্থ মনুষ্যত্বের এই স্বাধীনতার নামই নিজত্ব। এই নিজত্ব ব্যক্তভাবে ব্যক্তিবিশেষের, কিন্তু নিগৃঢ়ভাবে সমস্ত মানবের। মহৎব্যক্তিরা এই নিজত্বপ্রভাবে এক দিকে স্বতন্ত্র, একক, অন্য দিকে সমস্ত মানবজাতির সবৰ্ণ, সহােদর। আমাদের দেশে রামমোহন রায় এবং বিদ্যাসাগর উভয়ের জীবনেই ইহার পরিচয় পাওয়া যায়। এক দিকে যেমন তাহারা ভারতবর্ষীয়, তেমনি অপর দিকে য়ুরোপীয় প্রকৃতির সহিত র্তাহাদের চরিত্রের বিস্তর নিকটসাদৃশ্য দেখিতে পাই। অথচ তাহা অনুকরণগত সাদৃশ্য নহে। বেশভূষায় আচারে ব্যবহারে তাহারা সম্পূর্ণ বাঙালি ছিলেন ; ; স্বজাতীয় শাস্ত্ৰজ্ঞানে তাহাদের সমতুল্য কেহ ছিল না ; স্বজাতিকে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের মূলপত্তন তাহারাই করিয়া গিয়াছেন; অথচ নিভীক বলিষ্ঠতা, সত্যাচারিতা, লোকহিতৈষী, দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞা এবং আত্মনির্ভরতায় তাহারা বিশেষরূপে যুরোপীয় মহাজনদের সহিত তুলনীয় ছিলেন। যুরোপীয়দের তুচ্ছ বাহ্য অনুকরণের প্রতি তাহারা যে অবজ্ঞা প্ৰকাশ করিয়াছেন তাহাতেও তাঁহাদের যুরোপীয়সুলভ গভীর আত্মসম্মানবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। যুরোপীয় কেন, সরল সত্যপ্রিয় সাওতালেরাও যে অংশে মনুষ্যত্বে ভূষিত সেই অংশে বিদ্যাসাগর তাহার স্বজাতীয় বাঙালির অপেক্ষা সাওতালের সহিত আপনার অন্তরের যথার্থ ঐক্য অনুভব করিতেন। মাঝে মাঝে বিধাতার নিয়মের এরূপ আশ্চর্য ব্যতিক্রম হয় কেন, বিশ্বকৰ্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বুলা কঠিন। কী নিয়মে বড়োলোকের অভু্যত্থান হয় তাহা সকল দেশেই রহস্যময়—আমাদের এই ক্ষুদ্রকর্ম ভীরুহৃদয়ের দেশে সে রহস্য দ্বিগুণতর দুৰ্ভেদ্য। বিদ্যাসাগরের চরিত্রসৃষ্টিও রহস্যাবৃত ; কিন্তু ইহা দেখা যায়, সে চরিত্রের ছাঁচ ছিল ভালো। ঈশ্বরচন্দ্রের পূর্বপুরুষের মধ্যে মহত্ত্বের উপকরণ প্রচুর পরিমাণে সঞ্চিত ছিল। বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিলে প্রথমেই র্তাহার পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। লোকটি অনন্যসাধারণ ছিলেন তাহাতে সন্দেহমাত্ৰ নাই। মেদিনীপুর জেলায় বনমালীপুরে তাহার পৈতৃক বাসভবন ছিল। র্তাহার পিতার মৃত্যুর পরে বিষয়বিভাগ লইয়া সহােদরদের সহিত মনাস্তার হওয়ায় তিনি সংসার ত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। বহুকাল পরে তর্কভূষণ দেশে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন, তাহার স্ত্রী দুৰ্গাদেবী ভাশুর ও দেবরগণের অনাদরে প্রথমে শ্বশুরালয় হইতে বীরসিংহ গ্রামে পিত্ৰালয়ে, পরে সেখানেও ভ্ৰাতা ও ভ্ৰাতৃজায়ার লাঞ্ছনায় বৃদ্ধ পিতার সাহায্যে পিতৃভবনের অনতিদূরে এক কুটিরে বাস করিয়া চরকা কাটিয়া দুই পুত্ৰ ও চারি কন্যাসহ বহুকষ্টে দিনপাত করিতেছেন। তর্কভূষণ ভ্ৰাতাদের আচরণ শুনিয়া নিজের স্বত্ব ও তাহাদের সংস্রব ত্যাগ করিয়া ভিন্ন গ্রামে দারিদ্র্য অবলম্বন করিয়া রহিলেন। কিন্তু র্যাহার স্বভাবের মধ্যে মহত্ত্ব আছে, দারিদ্র্যে র্তাহাকে দরিদ্র করিতে পারে না। বিদ্যাসাগর স্বয়ং তাহার পিতামহের যে চরিত্র বর্ণনা করিয়াছেন, স্থানে স্থানে তাহা উদধূত করিতে ইচ্ছা করি। — SR | 8 S)