পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ Σ ΦΥΦ ভিড়ের মধ্যে মাঝে মাঝে চড়ের আওয়াজ ও চীৎকার কান্না যেন তারস্বরের হাউইয়ের মতো আকাশ ফুড়ে উঠছে। অস্তঃপুরের প্রাঙ্গণ থেকে উচ্ছিষ্ট ভাত তরকারির গন্ধে বাতাস অমগন্ধী ; সেখানে সর্বত্র ক্লাস্তি, অবসাদ ও মলিনতা। এই শূন্যতা অসহ্য হয়ে উঠল যখন মুকুন্দলাল আজও ফিরলেন না। নাগাল পাবার উপায় নেই বলেই নন্দরানীর ধৈর্যের বাধ হঠাৎ ফেটে খান খান হয়ে গেল। দেওয়ানজিকে ডাকিয়ে পরদার আড়াল থেকে বললেন, “কর্তাকে বলবেন, বৃন্দাবনে মার কাছে আমাকে এখনই যেতে হচ্ছে। তার শরীর ভালো নেই।” দেওয়ানজি কিছুক্ষণ টাকে হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “কর্তাকে জানিয়ে গেলেই ভালো হত মাঠাকরুন। আজকালের মধ্যে বাড়ি ফিরবেন খবর পেয়েছি।” “না, দেরি করতে পারব না।” নন্দরানীও খবর পেয়েছেন আজকালের মধ্যেই ফেরবার কথা । সেইজন্যেই যাবার এত তাড়া। নিশ্চয় জানেন, অল্প একটু কান্নাকাটি-সাধ্যসাধনাতেই সব শোধ হয়ে যাবে। প্রতিবারই এমনি হয়েছে। উপযুক্ত শাস্তি অসমাপ্তই থাকে। এবারে তা কিছুতেই চলবে না। তাই দণ্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েই দণ্ডদাতাকে পালাতে হচ্ছে। বিদায়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে পা সরতে চায় না— শোবার খাটের উপর উপুড় হয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কান্না। কিন্তু যাওয়া বন্ধ হল না। তখন কার্তিক মাসের বেলা দুটো। রৌদ্রে বাতাস আতপ্ত । রাস্তার ধারের সিসুতরুশ্রেণীর মর্মরের সঙ্গে মিশে কচিং গলাভাঙা কোকিলের ডাক আসছে। যে রাস্ত দিয়ে পালকি চলেছে সেখান থেকে র্কাচ ধানের খেতের পরপ্রান্তে নদী দেখা যায়। নন্দরানী থাকতে পারলেন না, পালকির দরজ। ফণক করে সে দিকে চেয়ে দেখলেন। ও পারের চরে বজরা বাধা আছে, চোখে পড়ল। মাস্তুলের উপর নিশেন উড়ছে। দূর থেকে মনে হল, বজরার ছাতের উপর চিরপরিচিত গুপি হরকরা বসে ; তার পাগড়ির তকমার উপর স্বর্যের আলো ঝকৃমক করছে। সবলে পালকির দরজা বন্ধ করে দিলেন, বুকের ভিতরটা পাথর হয়ে গেল । ט\ মুকুন্দলাল, যেন মাস্তুল-ভাঙ, পাল-ছেড়া, টোল-খাওয়া, তুফানে আছাড়-লাগা জাহাজ, সংকোচে বন্দরে এসে ভিড়লেন। অপরাধের বোঝায় বুক ভারী। প্রমোদের স্মৃতিটা যেন অতিভোজনের পরের উচ্ছিষ্টের মতো মনটাকে বিতৃষ্ণায়