পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী به ذ রথচক্রের শব্দ কুমু তার হৃৎস্পন্দনের মধ্যে ওই-যে শুনতে পাচ্ছে। বাইরের ছদ্মবেশট। সে যাচাই করে দেখতেই চায় না। তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়েই সে পাজি খুলে দেখলে, আজ মনোরথ-দ্বিতীয়া। বাড়িতে কর্মচারীদের মধ্যে যে-কয়জন ব্রাহ্মণ অাছে সন্ধ্যাবেল ডাকিয়ে তাদের ফলার করালে, দক্ষিণাও যথাসাধ্য কিছু দিলে। সবাই আশীৰ্বাদ করলে, রাজরানী হয়ে থাকে, ধনে-পুত্রে লক্ষ্মীলাভ হোক । দ্বিতীয়বার বিপ্রদাসের বৈঠকখানায় ঘটকের আগমন । তুড়ি দিয়ে শিব শিব বলে বৃদ্ধ উচ্চস্বরে হাই তুললে। এবারে অসম্মতি দিয়ে কথাটাকে শেষ করে দিতে বিপ্রদাসের সাহস হল না। ভাবলে এতবড়ো দায়িত্ব নিই কী করে ? কেমন করে নিশ্চয় জানব কুমুর পক্ষে এ সম্বন্ধ সবচেয়ে ভালো নয় ? পরশুদিন শেষকথা দেবে বলে ঘটককে বিদায় করে দিলে। S > সন্ধ্যার অন্ধকার মেঘের ছায়ায় বৃষ্টির জলে নিবিড়। কুমুর আসবাবপত্র বেশি কিছু নেই। এক পাশে ছোটো খাট, আলনায় গুটি দুয়েক পাকানো শাড়ি আর চাপ-রঙের গামছা । কোণে কাঠাল-কাঠের সিন্দুক, তার মধ্যে ওর ব্যবহারের কাপড়। খাটের নীচে সবুজ-রঙ-করা টিনের বাক্সে পান সাজবার সরঞ্জাম, আর একটা বাক্সে চুল বাধবার সামগ্ৰী। দেয়ালের খাজের মধ্যে কাঠের থাকে কিছু বই, দোয়াতকলম, চিঠির কাগজ, মায়ের হাতের পশমে-বোন। বাবার সর্বদা ব্যবহারের চটিজুতোজোড় ; শোবার খাটের শিয়রে রাধাকৃষ্ণের যুগলরাপের পট। দেয়ালের কোণে ঠেসানো একটা এসরাজ । ঘরে কুমু আলো জালায় নি। কাঠের সিন্দুকের উপর বসে জানলার বাইরে চেয়ে আছে। সামনে ইটের কলেবরওআল কলকাতা আদিম কালের বর্মকঠিন একটা অতি । কায় জন্তুর মতে, জলধারার মধ্য দিয়ে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে । মাঝে মাঝে তার গায়ে গায়ে আলোকশিখার বিন্দু। কুমুর মন তখন ছিল অদৃষ্টনিরূপিত তার ভাবীলোকের মধ্যে। সেখানকার ঘরবাড়ি-লোকজন সবই তার আপন আদর্শে গড়া। তারই মাঝখানে নিজের সতীলক্ষ্মী-রূপের প্রতিষ্ঠা— কত ভক্তি, কত পূজা, কত সেবা । তার নিজের মায়ের পুণ্যচরিতে এক জায়গায় একটা গভীর ক্ষত রয়ে গেছে। তিনি স্বামীর অপরাধে কিছুকালের জন্যেও ধৈর্য হারিয়েছিলেন। কুমু কখনও সে ভুল করবে না।