পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

さ〉8 রবীন্দ্র-রচনাবলী করি, সে দেখাবে ভালো। উপযুক্ত ব্রাহ্মণপণ্ডিত আনিয়ে আমাদের সামবেদের মতে বিশুদ্ধভাবে অনুষ্ঠান পালন করব। ওরা রাজা হয়েছে করুক আড়ম্বর ; আমরা ব্রাহ্মণ, পুণ্যকর্ম আমাদের।” নবগোপাল বললে, “দাদা, পাজি ভুলেছ, এটা সত্যযুগ নয়। জলের নৌকে। চালাতে চাও পাকের উপর দিয়ে! তোমার প্রজারা আছে – তিতু সরকার আছে তোমার তালুকদার— ভাদু পরামানিক, কমরদি বিশ্বেস, পাচু মণ্ডল— এরা কি তোমার ওই কাচকলাভাতে হবিন্তিা-করা বামনাইয়ের এক অক্ষর মানে বুঝবে ? এর কি যাজ্ঞবন্ধ্যের প্রপৌত্র ? এদের যে বুক ফেটে যাবে। তুমি চুপ করে থাকো, তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।” নবগোপাল প্রজাদের সঙ্গে মিলে উঠে-পড়ে লাগল। সবাই বুক ঠুকে বললে, টাকার জন্যে ভাবন কী ? অামলা ফয়লা পাইক বরকন্দাজ সবারই গায়ে চড়ল নতুন লাল বনাতের চাদর, রঙিন ধুতি। সালুতে-মোড়া ঝালর-ঝোলানো নিশেনওড়ানো এক নহবতখানা উঠল, সাত ক্রোশ তফাত থেকে তার চুড়ে দেখা যায়। দুই শরিকে মিলে তাদের চার-চার হাতি বের করলে, সাজ চড়ল তাদের পিঠে, যখনতখন বিনা কারণে ঘোষালদিঘির সামনের রাস্তায় শুড় দুলিয়ে দুলিয়ে তারা টহলিয়ে বেড়ায়, গলায় ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতে থাকে। আর যাই হোক, পাটের বস্তা থেকে হাতি বের হয় না, এই বলে সকলেই দুই পা চাপড়ে হে হে করে হেসে নিলে । অভ্রানের সাতাশে পড়েছে বিয়ের দিন ; এখনও দিনদশেক বাকি। এমন সময় লোকমুখে জানা গেল, রাজা আসছে দলবল নিয়ে। ভাবনা পড়ে গেল, কর্তব্য কী। মধুসূদন এদের কাছে কোনো খবর দেয় নি। বুঝি মনে করেছে ভদ্রতা সাধারণ লোকের, অভদ্রতাই রাজ্যেচিত। এমন অবস্থায় নিজের গায়ে পড়ে স্টেশন থেকে ওদের এগিয়ে আনতে যাওয়া কি সংগত হবে ? খবর না-দেওয়ার উচিত জবাব হচ্ছে খবর না-নেওয়া । সবই সত্য, কিন্তু যুক্তির দ্বারা সংসারে দুঃখ ঠেকানো যায় না। কুমুর প্রতি বিপ্রদাসের গভীর স্নেহ ; পাছে তাকে কিছুতে আঘাত করে এ কথাটা সকল তর্ক ছাড়িয়ে যায়। মেয়েদের পীড়ন করা এতই সহজ ; তাদের মর্মস্থান চার দিকেই অনাবৃত। জবরদস্তের হাতেই সমাজ চাবুক জুগিয়েছে ; আর যারা বর্মহীন তাদের স্পর্শকাতর পিঠের দিকে কোনো বিধিবিধান নজর করে না। এমন অবস্থায় স্নেহের ধনকে রোষ-বিদ্বেষ-ঈর্ষার তুফানে ভাসিয়ে দিয়ে নিজের অভিমান বঁাচাবার চেষ্টা করা কাপুরুষতা, বিপ্রদাসের মনের এই ভাব।