পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२२९ রবীন্দ্র-রচনাবলী পাশে বসে কুমু নিজের দুই ঠাণ্ড হাতের মধ্যে দাদার শুকনো গরম হাত তুলে নিলে। বিপ্রদাসের টেরিয়র কুকুর খাটের নীচে বিমর্ষ মনে চুপ করে শুয়ে ছিল। কুমু খাটে এসে বসতেই সে দাড়িয়ে উঠে দু পা তার কোলের উপর রেখে লেজ নাড়তে নাড়তে করুণ চোখে ক্ষীণ আর্তস্বরে কী যেন প্রশ্ন করলে । * বিপ্রদাসের মনে ভিতরে ভিতরে কী একটা চিন্তার ধারা চলছিল, তাই হঠাৎ এক সময়ে অসংলগ্নভাবে বলে উঠল, “দিদি, আসলে কিছুই নয়— কে বড়ো কে ছোটো কে উপরে কে নীচে, এ সমস্তই বানানো কথা। ফেনার মধ্যে বুদবুদগুলোর কোনটার কোথায় স্থান তাতে কী আসে যায় ? আপনার ভিতরে আপনি সহজ হয়ে থাকিস, কিছুতেই তোকে মারবে না।” “আমাকে আশীৰ্বাদ করে দাদা, আমাকে আশীৰ্বাদ করে,” বলে কুমু দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না চাপা দিলে। বিপ্রদাস বালিশে ঠেস দিয়ে একটু উঠে বসে কুমুর মুখ নামিয়ে ধরে তার মাথায় । চুমে খেলে। ডাক্তার ঘরে ঢুকে বললে, “আর নয় কুমুদিদি, এখন ওঁর একটু শাস্ত থাকা দরকার ।” কুমু রোগীর বালিশ একটু চেপে-চুপে ঠিক করে গায়ের উপর গরম কাপড়টা টেনে দিয়ে, পাশের টিপাইটার উপরকার বিশৃঙ্খলতা একটু সেরে নিয়ে দাদার কানের কাছে মৃদুস্বরে বললে, “সেরে গেলেই কলকাতায় যেয়ে দাদা, সেখানে তোমাকে দেখতে পাব ।” বিপ্রদাস বড়ে বড়ো দুই স্নিগ্ধ চোখ কুমুর মুখের উপর স্থির রেখে বললে, “কুমু, পশ্চিমের মেঘ যায় পুবে, পুবের মেঘ যায় পশ্চিমে, এসব হাওয়ায় হয়। সংসারে সেই হাওয়া বইছে । মেঘের মতোই অমনি সহজে এটাকে মেনে নিস দিদি। এখন থেকে আমাদের কথা বেশি ভাবিস নে । যেখানে যাচ্ছিস সেখানে লক্ষ্মীর আসন তুই জুড়ে থাকিস– এই আমার সকল মনের আশীৰ্বাদ । তোর কাছে আমরা আর কিছুই চাই নে ৷” s দাদার পায়ের কাছে কুমু মাথা রেখে পড়ে রইল। আজ থেকে আমার কাছে আর কিছুই চাবার নেই। এখানকার প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় আমার কোনো হাতই থাকবে না – এক মুহূর্তে এতবড়ো বিচ্ছেদের কথা মেনে নেওয়া যায় না। ঝড়ে যখন নৌকাকে ডাঙা থেকে টেনে নিয়ে যায় তখন নোঙর যেমন করে মাটি অঁাকড়ে থাকতে চায়, দাদার পায়ের কাছে কুমুর তেমনি এই শেষ ব্যগ্রতার বন্ধন ।