পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ২৩৩ তার পরে বরণ, স্ত্রী-আচার প্রভৃতির পালা শেষ হতে হতে যখন সন্ধ্যা হয়ে আসে তখন কালরাত্রির মুখে ক্রিয়াকর্ম সাঙ্গ হল। একটিমাত্র বড়ো বোনের বিবাহ কুমুর স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু তাদের নিজেদের বাড়িতে কোনো নতুন বউ আসতে সে দেখে নি। যৌবনারম্ভের পূর্বে থেকেই সে অাছে কলকাতায়, দাদার নির্মল স্নেহের আবেষ্টনে । বালিকার মনের কল্পজগৎ সাধারণ সংসারের মোট ছাচে গড় হতে পায় নি। বাল্যকালে পতিকামনায় যখন সে শিবের পূজা করেছে তখন পতির ধ্যানের মধ্যে সেই মহাতপস্বী রজতগিরিনিভ শিবকেই দেখেছে। সাধবী নারীর আদর্শরূপে সে আপন মাকেই জানত। কী স্নিগ্ধ শাস্ত কমনীয়ত, কত ধৈর্য, কত দুঃখ, কত দেবপূজা, মঙ্গলাচরণ, অক্লাস্ত সেবা । অপর পক্ষে তার স্বামীর দিকে ব্যবহারের ক্রটি চরিত্রের স্থলন ছিল ; তৎসত্ত্বেও সে চরিত্র ঔদার্যে বৃহৎ, পৌরুষে দৃঢ়, তার মধ্যে হীনতা কপটতা লেশমাত্র ছিল না, যে একটা মর্যাদাবোধ ছিল সে যেন দূরকালের পৌরাণিক আদর্শের। র্তার জীবনের মধ্যে প্রতিদিন এইটেই প্রমাণ হয়েছে যে, প্রাণের চেয়ে মান বড়ো, অর্থের চেয়ে ঐশ্বর্য । তিনি ও র্তার সমপর্যায়ের লোকেরা বড়ো বহরের মানুষ। তাদের ছিল নিজেদের ক্ষতি করেও অক্ষত সম্মানের গৌরব রক্ষা, অক্ষত সঞ্চয়ের অহংকার প্রচার নয়। কুমুর’ যেদিন বঁ। চোখ নাচল সেদিন সে তার সব ভক্তি নিয়ে, আত্মোৎসর্গের পূর্ণ সংকল্প নিয়ে প্রস্তুত হয়ে দাড়িয়েছিল। কোথাও কোনো বাধা বা খর্বত ঘটতে পারে এ কথা তার কল্পনাতেই আসে নি। দময়ন্তী কী করে আগে থাকতে জেনেছিলেন যে, বিদর্ভরাজ নলকেই বরণ করে নিতে হবে । তার মনের ভিতরে নিশ্চিত বার্তা এসে পোঁচেছিল– তেমনি নিশ্চিত বার্তা কি কুমু পায় নি ? বরণের আয়োজন সবই প্রস্তুত ছিল, রাজাও এলেন, কিন্তু মনে যাকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল, বাইরে তাকে দেখলে কই ? রূপেতেও বাধত না, বয়সেও বাধত না। কিন্তু রাজা ? সেই সত্যকার রাজা কোথায় ? তার পরে আজ, যে অনুষ্ঠানের দ্বার দিয়ে কুমুকে তার নতুন সংসারে আহবান করলে তাতে এমন কোনো বজ্ৰগম্ভীর মঙ্গলধ্বনি বাজল না কেন যার ভিতর দিয়ে এই নববধূ আকাশের সপ্তর্ষিদের আশীৰ্বাদমস্ত্র শুনতে পেত! সমস্ত অনুষ্ঠানকে পরিপূর্ণ করে এমন বন্দনাগান উদাত্ত স্বরে কেন জাগল না— জগতঃ পিতরেী বন্দে পার্বতীপরমেশ্বরেী সেই জগতঃ পিতরে যার মধ্যে চিরপুরুষ ও চিরনারী বাক্য ও অর্থের মতো একত্র মিলিত হয়ে আছে ?