পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ૨૭ જે বলেই ছাড়িয়েছেন। আমি লেগে রইলুম, যা হয় তা হোক। মনের গান কখন তার গলায় ফুটে উঠল তা টেরই পেলে না— দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। মোতির মা কথাটি বললে না, চুপ করে দেখলে, আর শুনলে। তার পরে কুমু যখন অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ল তখন মোতির মার মনে একটা চিন্তা দেখা দিল যা পূর্বে আর কখনও ভাবে নি। ও ভাবতে লাগল, আমাদের যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আমরা তো কচি খুকি ছিলুম, মন বলে একটা বালাই ছিল না। ছোটোছেলে কাচা ফলটাকে যেমন টপ করে বিনা আয়োজনে মুখে পুরে দেয়, স্বামীর সংসার তেমনি করেই বিনা বিচারে আমাদের গিলেছে, কোথাও কিছু বাধে নি। সাধন করে আমাদের নিতে হয় নি, আমাদের জন্যে দিন-গোনা ছিল অনাবশ্যক। যেদিন বললে ফুলশয্যে সেইদিনই হল ফুলশয্যে, কেননা ফুলশয্যের কোনো মানে ছিল না, সে ছিল একটা খেল । • এই তো কালই হবে ফুলশয্যে, কিন্তু এ মেয়ের পক্ষে সে কতবড়ো বিড়ম্বন ! বড়োঠাকুর এখনও পর ; আপন হতে অনেক সময় লাগে। একে ছোবে কী করে ? এ মেয়ের সেই অপমান সইবে কেন ? ধন পেতে বড়োঠাকুরের কত কাল লাগল আর মন পেতে দু-দিন সবুর সইবে না ? সেই লক্ষ্মীর দ্বারে হাটাহঁাটি করে মরতে হয়েছে, এ লক্ষ্মীর দ্বারে একবার হাত পাততে হবে না ? এত কথা মোতির মার মনে আসত না । এসেছে তার কারণ, কুমুকে দেখবামাত্রই ও তাকে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে। এই ভালোবাসার পূর্বভূমিকা হয়েছিল স্টেশনে যখন সে দেখেছিল বিপ্রদাসকে । যেন মহাভারত থেকে ভীষ্ম নেমে এলেন । বীরের মতো তেজস্বী মূর্তি, তাপসের মতো শান্ত মুখশ্ৰী, তার সঙ্গে একটি বিষাদের নম্রতা। মোতির মার মনে হয়েছিল কেউ যদি কিছু না বলে তবে একবার ওর পা দুটাে ছুয়ে আসি। সেই রূপ আজও সে ভুলতে পারে নি। তার পরে যখন কুমুকে দেখলে, মনে মনে বললে, দাদারই বোন বটে ! একরকম জাতিভেদ আছে যা সমাজের নয়, যা রক্তের— সে জাত কিছুতে ভাঙা যায় না। এই যে রক্তগত জাতের অসামঞ্জস্য এতে মেয়েকে যেমন মর্মান্তিক করে মারে পুরুষকে এমন নয়। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল বলে মোতির মা এই রহস্য নিজের মধ্যে বোঝবার সময় পায় নি— কিন্তু কুমুর ভিতর দিয়ে এই কথাটা সে নিশ্চিত করে অতুভব করলে । তার গা কেমন করতে লাগল। ও যেন একটা বিভীষিকার ছবি দেখতে পেলে— যেখানে একটা অজানা জন্তু লালায়িত রসনা মেলে গুড়ি মেরে বসে আছে, সেই অন্ধকার গুহার মুখে কুমুদিনী দাড়িয়ে দেবতাকে ডাকছে। মোতির