পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ २8७ মন পাবার জন্যে একটা আকাঙ্ক্ষা জেগেছে বলেই ওর এই তীব্র নিস্ফল রাগ। বলে উঠল, “আমি কাজের লোক, সময় কম, হিস্টরিয়া-ওআলী মেয়ের খেদমদগারি করবার ফুরসৎ আমার নেই, এই স্পষ্ট বলে দিচ্ছি।” কুমু’ ধীরে ধীরে বললে, “তুমি আমাকে অপমান করতে চাও? হার মানতে হবে । তোমার অপমান মনের মধ্যে নেব না ।” কুমু কাকে এ-সব কথা বলছে ? ওর বিস্ফারিত চোখের সামনে কে দাড়িয়ে আছে ? মধুসূদন অবাক হয়ে গেল, ভাবলে এ মেয়ে ঝগড়া করে না কেন । এর ভাবখানা কী ? মধুসুদন বক্রোক্তি করে বললে, “তুমি তোমার দাদার চেলা, কিন্তু জেনে রেখো, আমি তোমার সেই দাদার মহাজন, তাকে এক হাটে কিনে আর-এক হাটে বেচতে পারি।” ও যে কুমুর দাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ কথা কুমুর মনে দেগে দেবার জন্যে মূঢ় আর কোনো কথা খুজে পেলে না। কুমু বললে, “দেখো, নিষ্ঠুর হও তো হোয়ে, কিন্তু ছোটাে হোয়ে না।” বলে সোফার উপর বসে পড়ল । কর্কশস্বরে মধুসুদন বলে উঠল, “কী ! আমি ছোটাে! আর তোমার দাদা আমার চেয়ে বড়ে ?” কুমু বললে, “তোমাকে বড়ে জেনেই তোমার ঘরে এসেছি।” মধুসুদন ব্যঙ্গ করে বললে, “বড়ে জেনেই এসেছ না, টাকার লোভে ?” তখন কুমু সোফ থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে খোলা ছাদে মেজের উপর গিয়ে বসল। কলকাতায় শীতকালের কৃপণ রাত্রি, ধোয়ায় কুয়াশায় ঘোলা, আকাশ অপ্রসন্ন, তারার আলো যেন ভাঙা গলার কথার মতো। কুমুর মন তখন অসাড়, কোনো ভাবনা নেই, কোনো বেদনা নেই। একটা ঘন কুয়াশার মধ্যে সে যেন লুপ্ত হয়ে গেছে। কুমু যে এমন করে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাবে মধুসূদন এ একেবারে "ভাবতেই পারে নি। নিজের এই পরাভবের জন্যে সকলের চেয়ে রাগ হচ্ছে কুমুর দাদার উপর। শোবার ঘরে চৌকির উপরে বসে পড়ে শূন্য আকাশের দিকে সে একটা ঘুষি নিক্ষেপ করলে। খানিকক্ষণ বসে থেকে ধৈর্য আর রাখতে পারলে না। ধড়ফড় করে উঠে ছাদে বেরিয়ে ওর পিছনে গিয়ে ডাকলে, “বড়োবউ ” কুমু চমকে উঠে পিছন ফিরে দাড়ালে।