পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ২৫৩ কারখানার চিমনি। যে দুদিন কুমু এই ছাদে বসেছে ওই চিমনি থেকে উৎসারিত ধূমকুণ্ডলটাই তার একমাত্র দেখবার জিনিস ছিল— সমস্ত আকাশের মধ্যে ওই কেবল একটি যেন সজীব পদার্থ, কোন একটা আবেগে ফুলে ফুলে পাক দিয়ে দিয়ে উঠছে । " পিলমুজ প্রভৃতি মাজ সেরে অন্ধকার থাকতেই স্নান করে পুবদিকে মুখ করে কুমু ছাদে এসে বসেছে। ভিজে চুল পিঠের উপর এলিয়ে দেওয়া— সাজসজ্জার কোনো আভাসমাত্র নেই। একখানি মোটা সুতোর সাদা শাড়ি, সরু কলো পাড়, আর শীতনিবারণের জন্য একটা মোট এণ্ডি-রেশমের ওড়না । কিছুদিন থেকে প্রত্যাশিত প্রিয়তমের কাল্পনিক আদর্শকে অন্তরের মাঝখানে রেখে এই যুবতী আপন হৃদয়ের ক্ষুধ মেটাতে বসেছিল। তার যত পূজা, যত ব্রত, যত পুরাণকাহিনী, সমস্তই এই কল্পমূর্তিকে সজীব করে রেখেছিল। সে ছিল অভিসারিণী .তার মানস-বৃন্দাবনে— ভোরে উঠে সে গান গেয়েছে রামকেলী রাগিণীতে— হমারে তুমারে সম্প্রীতি লগী হৈ শুন মনমোহন প্যারে— যে অনাগত মানুষটির উদ্দেশে উঠছে তার আত্মনিবেদনের অর্ঘ্য, সমুখে এসে পৌছোবার আগেই সে যেন ওর কাছে প্রতিদিন তার পেয়াল পাঠিয়ে দিয়েছে। বর্ষার রাত্রে খিড়কির বাগানের গাছগুলি অবিশ্রাম ধারাপতনের আঘাতে আপন পল্লবগুলিকে যখন উতরোল করেছে তখন কানাড়ার স্বরে মনে পড়েছে তার ওই গান— বাজে ঝননন মেরে পায়েরিয়া কৈস করে যাউ ঘরোয়ারে। আপন উদাস মনটার পায়ে পায়ে নূপুর বাজছে ঝননন— উদ্দেশহারা পথে বেরিয়ে পড়েছে, কোনোকালে ফিরবে কেমন করে ঘরে । যাকে রূপে দেখবে এমনি করে কতদিন থেকে তাকে স্বরে দেখতে পাচ্ছিল। নিগৃঢ় আনন্দ-বেদনার পরিপূর্ণতার দিনে যদি মনের মতে কাউকে দৈবাৎ সে কাছে পেত তা হলে অস্তরের সমস্ত গুঞ্জরিত গানগুলি তখনই প্রাণ পেত রূপে । কোনো পথিক ওর দ্বারে এসে দাড়াল না। কল্পনার নিভৃত নিকুঞ্জগৃহে ও একেবারেই ছিল একল । এমন-কি, ওর সমবয়সী সঙ্গিনীও বিশেষ কেউ ছিল না। তাই এতদিন শু্যামস্বন্দরের পায়ের কাছে ওর নিরুদ্ধ ভালোবাসা পূজার ফুল -আকারে আপন নিরুদ্দিষ্ট দয়িতের উদ্দেশ খুজেছে। সেইজন্যেই ঘটক যখন বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এল কুমু তখন তার ঠাকুরেরই হুকুম