পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৬৮ রবীন্দ্র-রচনাবলী করিস নে। সেই কথাটাই আজ অর্ধরাত্রে অপ্রত্যাশিতভাবে কে মধুসুদনকে দিয়ে বলিয়ে নিলে । f মধুসূদন আবার তাকে বললে, “তুমি কি এখনও আমার উপর রাগ করে আছ?” কুমু বললে, “না, আমার রাগ নেই, একটুও না।” মধুসুদন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল । ও যেন মনে মনে কথা কইছে; অহুদিষ্ট কারও সঙ্গে যেন ওর কথা। মধুসুদন বললে, “তা হলে এ ঘর থেকে এসে তোমার আপন ঘরে।” কুমু আজ রাত্রে প্রস্তুত ছিল না। ঘুমের থেকে জেগে উঠেই হঠাৎ মনকে বেঁধে তোলা কঠিন। কাল সকালে স্নান করে দেবতার কাছে তার প্রতিদিনের প্রার্থনা-মন্ত্র পড়ে তবে কাল থেকে সংসারে তার সাধনা আরম্ভ হবে এই সংকল্প সে করেছিল। তখন ওর মনে হল, ঠাকুর আমাকে সময় দিলেন না, আজ এই গভীর রাত্রেই ডাক দিলেন। তাকে কেমন করে বলব যে, “মা”। মনের ভিতরে যে একটা প্রকাও অনিচ্ছা হচ্ছিল তাকে অপরাধ বলে কুমু ভয় পেলে। এই অনিচ্ছার বাধা তাকে টেনে রাখছিল বলেই কুমু জোরের সঙ্গে উঠে দাড়ালে, বললে, “চলে ।” উপরে উঠে তার শোবার ঘরের সামনে একটু থমকে দাড়িয়ে সে বললে, “আমি এখনই আসছি, দেরি করব না।” বলে ছাদের কোণে গিয়ে বসে পড়ল। কৃষ্ণপক্ষের খণ্ড চাদ তখন মধ্য আকাশে । নিজের মনে মনে কুমু বার বার করে বলতে লাগল, ‘প্রভু, তুমি ডেকেছ আমাকে, তুমি ডেকেছ। আমাকে ভোল নি বলেই ডেকেছ । আমাকে কাটাপথের উপর দিয়েই নিয়ে যাবে— সে তুমিই, সে তুমিই, সে আর কেউ নয়।’ আর-সমস্তকেই কুমু লুপ্ত করে দিতে চায়। আর সমস্তই মায়া, আর-সমস্তই যদি কাটাও হয় তবু সে পথেরই কাটা, আর সে তারই পথের কাটা। সঙ্গে পাথেয় আছে, তার দাদার আশীৰ্বাদ । সেই আশীৰ্বাদ সে যে আঁচলে বেঁধে নিয়েছে। সেই আঁচলে বাধা আশীৰ্বাদ বার বার মাথায় ঠেকালে । তার পরে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করলে। এমন সময় হঠাৎ চমকে উঠল, পিছন থেকে মধুসুদন বলে উঠল, “বড়োবউ, ঠাণ্ড লাগবে, ঘরে এসো।” অন্তরের মধ্যে কুমু যে বাণী শুনতে চায় তার সঙ্গে এ কষ্ঠের স্বর তো মেলে না ! এই তো তার পরীক্ষা, ঠাকুর আজ তাকে বাশি দিয়েও ডাকবেন না। তিনি রইবেন আজ ছদ্মবেশে ।