পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ &br☾ মোতির মাকে কোনো ছুতোয় কুমু যদি রাখতে পারত তা হলে সে বেঁচে যেত। কিন্তু নবীন গেল চলে, হতবুদ্ধি মোতির মাও আস্তে আস্তে চলল তার পিছনে দরজার কাছে এসে একবার মুখ আড় করে উদ্বিগ্নভাবে কুমুদিনীর মুখের দিকে চেয়ে গেল। স্বামীর প্রসন্নতার হাত থেকে এই মেয়েটিকে এখন কে বাচাবে ? মধুসূদন বললে, “বড়োবউ, কাপড় ছেড়ে শুতে আসবে না ?” কুমু ধীরে ধীরে উঠে পাশের নাবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলে— মুক্তির মেয়াদ যতটুকু পারে বাড়িয়ে নিতে চায়। সে ঘরে দেওয়ালের কাছে একটা চৌকি ছিল সেইটেতে বসে রইল। তার ব্যাকুল দেহটা যেন নিজের মধ্যে নিজের অন্তরাল খুজছে। মধুসূদন মাঝে মাঝে দেওয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকায় আর হিসেব করতে থাকে কাপড় ছাড়বার জন্যে কতটা সময় দরকার। ইতিমধ্যে আয়নাতে নিজের মুখটা দেখলে, মাথার তেলোর যে জায়গাটাতে কড়া চুলগুলো বেমানান রকম খাড়া হয়ে থাকে বৃথা তার উপরে কয়েকবার বুরুশের চাপ লাগালে আর গায়ের কাপড়ে অনেকখানি দিলে ল্যাভেণ্ডার ঢেলে । পনেরো মিনিট গেল ; বেশ-বদলের পক্ষে সে সময়টা যথেষ্ট। মধুসূদন চুপি চুপি একবার নাবার ঘরের দরজার কাছে কান দিয়ে দাড়াল, ভিতরে নড়াচড়ার কোনো শব্দ নেই– মনে ভাবলে কুমু হয়তো চুলটার বাহার করছে, খোপাট নিয়ে ব্যস্ত। মেয়ের সাজ করতে ভালোবাসে মধুসূদনেরও এ আন্দাজটা ছিল, অতএব সবুর করতেই হবে। আধঘণ্টা হল— মধুসুদন আর-একবার দরজার উপর কান লাগালে, এখনও কোনো শব্দ নেই। ফিরে এসে কেদারায় বসে পড়ে খাটের সামনের দেয়ালে বিলিতি যে ছবিটা ঝোলানে ছিল তার দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ এক সময়ে ধড়ফড় করে উঠে রুদ্ধ দ্বারের কাছে দাড়িয়ে ডাক দিলে, “বড়োবউ, এখনও হয় নি ?” একটু পরেই আস্তে আস্তে দরজা খুলে গেল। কুমুদিনী বেরিয়ে এল, যেন সে স্বপ্নে-পাওয়া। যে কাপড় পরা ছিল তাই আছে ; এ তো রাত্রে শোবার সাজ নয়। গায়ে একখান প্রায় পুরে হাতী-ওআল ব্রাউন রঙের সার্জের জাম, একটা লালপেড়ে বাদামি রঙের আলোয়ানের আঁচল মাথার উপর টেনে-দেওয়া। দরজার একটা পাল্লায় বঁ৷ হাত রেখে যেন কী দ্বিধার ভাবে দাড়িয়ে রইল— একখানি অপরূপ ছবি ! নিটোল গৌরবর্ণ হাতে মকরমুখো প্লেন সোনার বালা— সেকেলে ছাদের— বোধ হয় এককালে তার মায়ের ছিল। এই মোট ভারী বালা তার সুকুমার হাতকে যে-ঐশ্বর্যের মর্যাদা দিয়েছে সেটি ওর পক্ষে এত সহজ যে, ওই অলংকারটা ওর শরীরে