পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

९br७ রবীন্দ্র-রচনাবলী একটুমাত্র আড়ম্বরের স্বর দেয় নি। মধুসূদন ওকে আবার যেন নতুন করে দেখলে। ওর মহিমায় আবার সে বিস্মিত হল। মধুসূদনের চিরার্জিত সমস্ত সম্পদ এতদিন পরে শ্রীলাভ করেছে এ কথা না মনে করে সে থাকতে পারলে না। সংসারে যে-সব লোকের সঙ্গে মধুসূদনের সর্বদা দেখাসাক্ষাৎ তাদের অধিকাংশের চেয়ে নিজেকে ধনগৌরবে অনেক বড়ো মনে করা তার অভ্যাস। আজ গ্যাসের আলোতে শোবার ঘরের দরজার পাশে ওই যে মেয়েটি স্তন্ধ দাড়িয়ে, তাকে দেখে মধুসূদনের মনে হল, আমার যথেষ্ট ধন নেই– মনে হল, যদি রাজচক্রবর্তী সম্রাট হতুম তা হলেই ওকে এ ঘরে মানাত। যেন প্রত্যক্ষ দেখতে পেলে এর স্বভাবটি জন্মাবধি লালিত একটি বিশুদ্ধ বংশমর্যাদার মধ্যে—অর্থাৎ এ যেন এর জন্মের পূর্ববর্তী বহু দীর্ঘকালকে অধিকার করে দাড়িয়ে । সেখানে বাইরে থেকে যে-সে প্রবেশ করতেই পারে না— সেখানেই আপন স্বাভাবিক স্বত্ব নিয়ে বিরাজ করছে বিপ্রদাস— তাকেও ওই কুমুর মতোই একটি আত্মবিস্মৃত সহজ গৌরব সর্বদা ঘিরে রয়েছে। মধুসূদন এই কথাটাই কিছুতে সহ করতে পারে না। বিপ্রদাসের মধ্যে ঔদ্ধত্য একটুও নেই আছে একটা দূরত্ব। অতিবড়ো আত্মীয়ও যে হঠাৎ এসে তার পিঠ চাপড়িয়ে বলতে পারে ‘কী হে, কেমন ? এ যেন অসম্ভব। বিপ্রদাসের কাছে মধুসূদন মনে মনে কী রকম খাটাে হয়ে থাকে সেইটেতে তার রাগ ধরে। সেই একই স্বক্ষ কারণে কুমুর উপরে মধুসূদন জোর করতে পারছে না— আপন সংসারে যেখানে সবচেয়ে তার কর্তৃত্ব করবার অধিকার সেইখানেই সে যেন সবচেয়ে হটে গিয়েছে। কিন্তু এখানে তার রাগ হয় না— কুমুর প্রতি আকর্ষণ দুর্নিবার বেগে প্রবল হয়ে ওঠে। আজ কুমুকে দেখে মধুসূদন স্পষ্টই বুঝলে কুমু তৈরি হয়ে আসে নি— একটা অদৃশু আড়ালের পিছনে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু কী সুন্দর! কী একটা দীপ্যমান শুচিত, শুভ্রতা ! যেন নির্জন তুষারশিখরের উপরে নির্মল উষা দেখা দিয়েছে । মধুসূদন একটু কাছে এগিয়ে এসে ধীর স্বরে বললে, “শুতে আসবে না বড়োবউ ?” কুমু আশ্চর্য হয়ে গেল। সে নিশ্চয় মনে করেছিল মধুসূদন রাগ করবে, তাকে অপমানের কথা বলবে । হঠাৎ একটা চিরপরিচিত সুর তার মনে পড়ে গেল— তার বাবা স্নিগ্ধ গলায় কেমন করে তার মাকে বড়োবউ বলে ডাকতেন। সেইসঙ্গেই মনে পড়ল— মা তার বাবাকে কাছে আসতে বাধা দিয়ে কেমন করে চলে গিয়েছিলেন । এক মুহূর্তে তার চোখ ছলছলিয়ে এল— মাটিতে মধুসূদনের পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে উঠল, “আমাকে মাপ করে।”