পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२89रै রবীন্দ্র-রচনাবলী “ওই শোনো ! এ তে সবাই জানে। আমাদের রান্নাঘরের পার্বতী ষে বললে, ওঁর বাপের বাড়ির সরকার এসেছিল রাজাবাহাদুরের কাছে, বউয়ের খবর নিতে। তার কাছে শুনেছে, চিকিৎসার জন্যে বউয়ের দাদা আজকালের মধ্যেই কলকাতায় আসছেন।” কুমু উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “তার ব্যামো কি বেড়েছে ?” Ç “তা বলতে পারি নে। তবে এমন কিছু ভাবনার কথা নেই, তা হলে শুনতুম।” খাম বুঝেছিল ওর দাদার খবর মধুসূদন কুমুকে দেয় নি, যে বউয়ের মন পায় নি পাছে সে বাড়িমুখে হয়ে আরও অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কুমুর মনটাকে উসকিয়ে দিয়ে বললে, “তোমার দাদার মতো মানুষ হয় না এই কথা সবার কাছেই শুনি। বকুলফুল, চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে, ভাড়ার দিতে হবে । আপিসের রান্না চড়াতে দেরি হলে মুশকিল বাধবে।” মোতির মা দুধের বাটিটা আর-একবার কুমুর কাছে এগিয়ে নিয়ে বললে, “দিদি, দুধ ঠাণ্ড হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে ফেলে লক্ষ্মীটি।” এবার কুমু দুধ খেতে আপত্তি করলে না। মোতির মা কানে কানে জিজ্ঞাসা করলে, “ভাড়ারঘরে যাবে আজ ?” কুমু বললে, “আজ থাকৃ— গোপালকে আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দাও।” একটা কালো কঠোর ক্ষুধিত জরা বাহির থেকে কুমুকে গ্রাস করছে রাহুর মতো । যে পরিণত বয়স শান্ত স্নিগ্ধ শুভ্ৰ সুগম্ভীর, এ তে তা নয় ; যা লালায়িত, যার সংযমের শক্তি শিথিল, যার প্রেম বিষয়াসক্তিরই স্বজাতীয়, তারই স্বেদাক্ত স্পর্শে কুমুর এত বিতৃষ্ণ । ওর স্বামীর বয়স বেশি বলে কুমুর কোনো আক্ষেপ ছিল না, কিন্তু সেই বয়স নিজের মর্যাদা ভুলেছে বলে তার এত পীড়া। সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন একটা ফলের মতে, আলো-হাওয়ায় মুক্তির মধ্যে সে পাকে, কাচা ফলকে জাতীয় পিষলেই তো পাকে না। সময় পেল না বলেই আজ ওদের সম্বন্ধ কুমুকে এমন করে মারছে, এত অপমান করছে। কোথায় পালাবে ! মোতির মাকে ওই যে বললে, গোপালকে ডেকে দাও, সে এই পালাবার পথ খোজা— বৃদ্ধ অশুচিতার কাছ থেকে নবীন নির্মলতার মধ্যে, দূষিত নিশ্বাসবাষ্প থেকে ফুলের বাগানের হাওয়ায়। একটা পাতলা তুলে-ভরা ছিটের জামা গায়ে দিয়ে হাবলু সিড়ির দরজার কাছে এসে ভয়ে ভয়ে দাড়াল। ওর মায়ের মতোই বড়ো বড়ো কালো চোখ, তেমনিই জলভরা মেঘের মতে সরস শামলা রঙ, গাল দুটাে ফুলে ফুলে, প্রায় ন্যাড়া করে চুল ছাট । কুমু উঠে গিয়ে সংকুচিত হাবলুকে টেনে এনে বুকে চেপে ধরলে ; বললে, “দুষ্ট, ছেলে, এ দুদিন আস নি কেন ?”