পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ WS) o o 8ミ মধুসূদনের মন থেকে মন্ত একটা ভার গেল নেমে, আত্মগৌরবের ভার— যে কঠোর গৌরব-বোধ ওর বিকাশোন্মুখ অনুরক্তিকে কেবলই পাথর-চাঁপা দিয়েছে। কুমুর প্রতি ওর মন যখন মুগ্ধ তখনও সেই বিহ্বলতার বিরুদ্ধে ভিতরে ভিতরে চলেছিল লড়াই। যতই অনন্যগতি হয়ে কুমুর কাছে ধরা দিয়েছে, ততই নিজের অগোচরে কুমুর পরে ওর ক্রোধ জমেছে। এমন সময় স্বয়ং নক্ষত্রদের কাছ থেকে যখন আদেশ এল যে, লক্ষ্মী এসেছেন ঘরে, তাকে খুশি করতে হবে, সকল দ্বন্দ্ব ঘুচে গিয়ে ওর দেহমন যেন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল ; বার বার আপন মনে আবৃত্তি করতে লাগল— লক্ষ্মী, অামারই ঘরে লক্ষ্মী, আমার ভাগ্যের পরম দান। ইচ্ছে করতে লাগল— এখনই সমস্ত সংকোচ ভাসিয়ে দিয়ে কুমুর কাছে স্তুতি জানিয়ে আসে, বলে আসে, যদি কোনো ভুল করে থাকি, অপরাধ নিয়ে না। কিন্তু আজ আর সময় নেই, ব্যবসায়ের ভাঙন সারবার কাজে এখনই আপিসে ছুটতে হবে, বাড়িতে খেয়ে যাবার অবকাশ পর্যন্ত জুটল না। I এদিকে সমস্তদিন কুমুর মনের মধ্যে তোলপাড় চলেছে। সে জানে কাল আসবেন, শরীর তার অসুস্থ। তার সঙ্গে দেখাটা সহজ হবে কি না নিশ্চিত জানবার জন্যে মন উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। নবীন কোথায় কাজে গেছে, এখনও এল না। সে নিঃসন্দেহ জানত আজ স্বয়ং মধুসূদন এসে বউরানীকে সকল রকমে প্রসন্ন করবে ; আগেভাগে কোনো আভাস দিয়ে রসভঙ্গ করতে চায় না । আজ ছাতে বসবার সুবিধা ছিল না। কাল সন্ধ্যা থেকে মেঘ করে আছে, আজ দুপুর থেকে টিপু টিপ্‌ করে বৃষ্টি শুরু হল। শীতকালের বাদলা, অনিচ্ছিত অতিথির মতো । মেঘে রঙ নেই, বৃষ্টিতে ধ্বনি নেই, ভিজে বাতাসটা যেন মনমরা, সূর্যালোকহীন আকাশের দৈন্যে পৃথিবী সংকুচিত। সিড়ি থেকে উঠেই শোবার ঘরে ঢোকবার পথে যে ঢাকা ছাদ আছে সেইখানে কুমু মাটিতে বসে। থেকে থেকে গায়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। আজ এই ছায়ামান আর্দ্র একঘেয়ে দিনে কুমুর মনে হল, তার নিজের জীবনট তাকে যেন অজগরের মতে গিলে ফেলেছে, তারই ক্লেদাক্ত জঠরের রুদ্ধতার মধ্যে কোথাও একটুমাত্র ফাক নেই। যে দেবতা ওকে ভুলিয়ে আজ এই নিরুপায় নৈরাশ্বের মধ্যে এনে ফেললে তার উপরে যে অভিমান ওর মনে ধোয়াচ্ছিল আজ সেট ক্রোধের আগুনে জলে উঠল। হঠাৎ দ্রুত উঠে পড়ল। ডেস্ক খুলে বের করলে সেই যুগলরূপের পট । রঙিন রেশমের ছিট দিয়ে সেটা মোড় ।