পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ర్సిలి সবাইকে যেন জানিয়ে দিতে চাইলে যে, সে চলেছে কুমুর সঙ্গে দেখা করতে। আজ বুঝেছে পৃথিবীর লোকে ওকে ঈর্ষা করতে পারে এতবড়ে ওর সৌভাগ্য। খানিকক্ষণের জন্যে বৃষ্টি ধরে গেছে। তখনও সব ঘরে আলো জলে নি । আন্দিবুড়ি ধুমুচি হাতে ধুনো দিয়ে বেড়াচ্ছে ; একটা চামচিকে উঠোনের উপরের আকাশ থেকে লণ্ঠনজাল অন্তঃপুরের পথ পর্যন্ত কেবলই চক্রপথে ঘুরছে। বারান্দায় পা মেলে দিয়ে দাসীরা উরুর উপরে প্রদীপের সলতে পাকাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি উঠে ঘোমটা টেনে দৌড় দিলে। পায়ের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল শু্যামাসুন্দরী, হাতে বাটাতে ছিল পান। মধুসূদন আপিস থেকে এলে নিয়মমত এই পান সে বাইরে পাঠিয়ে দিত। সবাই জানে, ঠিক মধুসূদনের রুচির মতো পান খামান্বন্দরীই সাজতে পারে ; এইটে জানার মধ্যে আরও কিছু-একটু জানার ইশারা ছিল। সেই জোরে পথের মধ্যে খামা মধুর সামনে বাট খুলে ধরে বললে, “ঠাকুরপো, তোমার পুনে সাজা আছে, নিয়ে যাও।” আগে হলে এই উপলক্ষে দুটো-একটা কথা হত, আর সেই কথায় অল্প একটু মধুর রসের আমেজও লাগত। আজ কী হল কে জানে পাছে দূর থেকেও খামার ছোয়াচ লাগে সেইটে এড়িয়ে পান না নিয়ে মধুসূদন দ্রুত চলে গেল। খামার বড়ে বড়ো চোখদুটাে অভিমানে জলে উঠল, তার পরে ভেসে গেল অশ্রুজলের মোটা মোটা ফোটায়। অন্তর্যামী জানেন শু্যামাসুন্দরী মধুসূদনকে ভালোবাসে । মধুসূদন ঘরে ঢুকতেই নবীন কুমুর পায়ের ধুলো নিয়ে উঠে দাড়িয়ে বললে, “গুরুর কথা মনে রইল, খোজ করে দেখব।” দাদাকে বললে, “বউরানী গুরুর কাছ থেকে শাস্ত্র-উপদেশ শুনতে চান। আমাদের গুরুঠাকুর আছেন, কিন্তু—” মধুস্থদন উত্তেজনার স্বরে বলে উঠল, “শাস্ত্র-উপদেশ ! আচ্ছ সে দেখব এখন, তোমাকে কিছু করতে হবে না।” নবীন চলে গেল । মধুসূদন আজ সমস্ত পথ মনে মনে আবৃত্তি করতে করতে এসেছিল, "বড়োবউ, তুমি এসেছ আমার ঘর আলো হয়েছে।” এরকম ভাবের কথা বলবার অভ্যাস ওঁর একেবারেই নেই। তাই ঠিক করেছিল, ঘরে ঢুকেই দ্বিধা না করে প্রথম কোকেই সে বলবে । কিন্তু নবীনকে দেখেই কথাটা গেল ঠেকে। তার উপরে এল শাস্ত্রউপদেশের প্রসঙ্গ, ওর মুখ দিলে একেবারে বন্ধ করে । অস্তরে যে আয়োজনট চলছিল, এই একটুখানি বাধাতেই নিরন্ত হয়ে গেল। তার পরে কুমুর মুখে দেখলে একটা ভয়ের ভাব, দেহমনের একটা সংকোচ,। অন্তদিন হলে এটা চোখে পড়ত না ।