যোগাযোগ ৩২৫ এতক্ষণ ধরে এমনতরো উত্তেজনার কথা কুমুর মুখে মোতির মা আর কোনোদিন শোনে নি। বিশেষ করে আজ যেদিন বড়োঠাকুরকে ওরা কুমুর প্রতি এতটা প্রসন্ন করে এনেছে, সেইদিনই কুমুর এই তীব্র অধৈর্য দেখে মোতির মা ভয় পেয়ে গেল। বুঝলে লতার একেবারে গোড়ায় ঘা লেগেছে, উপর থেকে অনুগ্রহের জল ঢেলে মালী আর একে তাজ করে তুলতে পারবে না। একটু পরে কুমু বলে উঠল, “জানি, স্বামীকে এই যে শ্রদ্ধার সঙ্গে আত্মসমর্পণ করতে পারছি নে এ আমার মহাপাপ। কিন্তু সে পাপেও আমার তেমন ভয় হচ্ছে না যেমন হচ্ছে শ্রদ্ধাহীন আত্মসমর্পণের গ্লানির কথা মনে করে।” মোতির মা কোনো উত্তর না ভেবে পেয়ে হতবুদ্ধির মতো বসে রইল। একটু চুপ করে থেকে কুমু বললে, “তোমার কত ভাগ্যি ভাই, কত পুণ্যি করেছিলে, ঠাকুরপোকে এমন সমস্ত মনটা দিয়ে ভালোবাসতে পেরেছ। আগে মনে করতুম, .ভালোবাসাই সহজ— সব স্ত্রী সব স্বামীকে আপনিই ভালোবাসে । আজ দেখতে পাচ্ছি ভালোবাসতে পারাটাই সবচেয়ে দুর্লভ, জন্মজন্মাস্তরের সাধনায় ঘটে। আচ্ছ। ভাই, সত্যি বলে সব স্ত্রীই কি স্বামীকে ভালোবাসে ?” মোতির মা একটু হেসে বললে, “ভালো না বাসলেও ভালো স্ত্রী হওয়া যায়, নইলে সংসার চলবে কী করে ?” “সেই আশ্বাস দাও আমাকে। আর কিছু না হই ভালো স্ত্রী যেন হতে পারি। পুণ্য তাতেই বেশি, সেইটেই কঠিন সাধনা।” “বাইরে থেকে তাতেও বাধা পড়ে।” “অন্তর থেকে সে বাধা কাটিয়ে উঠতে পারা যায়। আমি পারব, আমি হার মানব না ।” “তুমি পারবে না তো কে পারবে ?” বৃষ্টি জোর করে চেপে এল। বাতাসে ল্যাম্পের আলো থেকে থেকে চকিত হয়ে ওঠে। দমকা হাওয়া যেন একটা ভিজে নিশাচর পাখির মতে পাখী ঝাপটে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কুমুর শরীরটা মনটা শিরশির করে উঠল। সে বললে, “আমার ঠাকুরের নামে আর জোর পাচ্ছি নে। মন্ত্র আবৃত্তি করে যাই, মনটা মুখ ফিরিয়ে থাকে, কিছুতে সাড়া দিতে চায় না। তাতেই সবচেয়ে ভয় হয়।” বানানো কথায় মিথ্যে ভরসা দিতে মোতির মার ইচ্ছে হল না। কোনো উত্তর না করে সে কুমুকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরলে। এমন সময় বাইরে থেকে আওয়াজ পাওয়া গেল, “মেজেবিউ ।”
পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৩
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।