পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ৩৬১ অস্থখ বাড়বে।” বলে একটু জোর করেই পিঠের দিকের উচু-করা বালিশের উপর বিপ্রদাসকে হেলিয়ে শুইয়ে দিলে। বিপ্রদাস গায়ের কাপড়টাকে মুঠো দিয়ে চেপে ধরে বললে, “সহ করা ছাড়া মেয়েদের অন্য কোনো রাস্ত একেবারেই নেই বলেই তাদের উপর কেবলই মার এসে পড়ছে। বলবার দিন এসেছে যে সহ করব না। কুমু, এখানেই তোর ঘর মনে করে থাকতে পারবি ? ও বাড়িতে তোর যাওয়া চলবে না।” কালুর কাছ থেকে বিপ্রদাস আজ অনেক কথা শুনেছে। শু্যামামুন্দরীর সঙ্গে মধুসূদনের যে সম্বন্ধ ঘটেছে তার মধ্যে অপ্রকাশ্বত আর ছিল না। ওরা দুই পক্ষই অকুষ্ঠিত। লোকে ওদেরকে অপরাধী মনে করছে মনে করেই ওরা স্পধিত হয়ে উঠেছে। এই সম্বন্ধটার মধ্যে সূক্ষ কাজ কিছুই ছিল না বলেই পরস্পরকে এবং লোকমতকে বাচিয়ে চল। ওদের পক্ষে ছিল . অনাবশ্বক। শোনা গেছে শু্যামাম্বন্দরীকে মধুসূদন কখনও কখনও মেরেওছে, তাম যখন তারস্বরে কলহ করেছে তখন মধুসুদন তাকে সকলের সামনেই বলেছে, ‘দুর হয়ে যা বজাত, বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। কিন্তু এতেও কিছু আসে যায় নি। খামার সম্বন্ধে মধুসুদন আপন কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ বজায় রেখেছে, ইচ্ছে করে মধুসূদন নিজে তাকে যা দিয়েছে শু্যাম যখনই তার বেশি কিছুতে হাত দিতে গেছে অমনি খেয়েছে ধমক ৷ খামার ইচ্ছে ছিল সংসারের কাজে মোতির মার জায়গাটা সেই দখল করে, কিন্তু তাতেও বাধা পেলে ; মধুসূদন মোতির মাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে, খামান্বন্দরীকে বিশ্বাস করে না। খামার সম্বন্ধে ওর কল্পনায় রঙ লাগে নি, অথচ খুব মোট রকমের একটা আসক্তি জন্মেছে। যেন শীতকালের বহুর্যবহৃত ময়লা রেজাইটার মতে, তাতে কারুকাজের সম্পূর্ণ অভাব, বিশেষ যত্ব করবার জিনিস নয়, খাট থেকে ধুলোয় পড়ে গেলেও আসে যায় না। কিন্তু ওতে আরাম আছে। খামাকে সামলিয়ে চলবার একটুও দরকার নেই ; তা ছাড়া শু্যাম সমস্ত মনপ্রাণের সঙ্গে ওকে যে বড়ো বলে মানে, ওর জন্যে সব সইতে সব করতে সে রাজি, এটা নিঃসংশয়ে জানার দরুন মধুসূদনের আত্মমর্যাদা স্বস্থ আছে। কুমু থাকতে প্রতিদিন ওর এই আত্মমর্যাদা বড়ে বেশি নাড়া খেয়েছিল। মধুসূদনের এই আধুনিক ইতিহাসটা জানবার জন্যে কালুকে খুব বেশি সন্ধান করতে হয় নি। ওদের বাড়িতে লোকজনের মধ্যে এই নিয়ে ষথেষ্ট বলাবলি চলেছিল, অবশেষে নিতান্ত অভ্যস্ত হওয়াতে বলাবলির পালাও একরকম শেষ হয়ে এসেছে ।