পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ৩৬৭ লড়াইয়ের হাওয়া উঠেছে। যত-সব ইচ্ছাকৃত অন্ধ দাসত্বকে বড়ে নাম দিয়ে মানুষ দীর্ঘকাল পোষণ করেছে, তারই বাসা ভাঙবার দিন এল।” কুমু মাথা নিচু করেই বললে, “দাদা, তুমি কি বল স্ত্রী স্বামীকে অতিক্রম করবে ?” “অন্যায় অতিক্রম করা মাত্রকেই দোষ দিচ্ছি। স্বামীও স্ত্রীকে অতিক্রম করবে না— এই আমার মত ।” “যদি করে, স্ত্রী কি তাই বলে—” কুমুর কথা শেষ না হতেই বিপ্রদাস বললে, “স্ত্রী যদি সেই অন্যায় মেনে নেয় তবে সকল স্ত্রীলোকের প্রতিই তাতে করে অন্যায় করা হবে। এমনি করে প্রত্যেকের দ্বারাই সকলের দুঃখ জমে উঠেছে। অত্যাচারের পথ পাকা হয়েছে।” মোতির মা একটু অধৈর্যের স্বরেই বললে, “আমাদের বউরানী সতীলক্ষ্মী, অপমান করলে সে অপমান ওঁকে স্পশ করতেও পারে না।” • বিপ্রদাসের কণ্ঠ এইবার উত্তেজিত হয়ে উঠল, “তোমরা সতীলক্ষ্মীর কথাই ভাবছ আর যে কাপুরুষ তাকে অবাধে অপমান করবার অধিকার পেয়ে সেটাকে প্রতিদিন খাটাচ্ছে তার দুর্গতির কথা ভাবছ না কেন ?” কুমু তখনই উঠে দাড়িয়ে বিপ্রদাসের চুলের মধ্যে আঙল বুলোতে বুলোতে বললে, "দাদা, তুমি আর কথা কোয়ে না। তুমি যাকে মুক্তি বল, যা জ্ঞানের দ্বারা হয়, আমাদের রক্তের মধ্যে তার বাধা । আমরা মানুষকেও জড়িয়ে থাকি, বিশ্বাসকেও ; কিছুতেই তার জট ছাড়াতে পারি নে। যতই ঘা থাই ঘুরে ফিরে আটকা পড়ি। তোমরা অনেক জান তাতেই তোমাদের মন ছাড়া পায়, আমরা অনেক মানি তাতেই আমাদের জীবনের শূন্ত ভরে। তুমি যখন বুঝিয়ে দাও তখন বুঝতে পারি হয়তো আমার ভুল আছে। কিন্তু ভুল বুঝতে পারা, আর ভুল ছাড়তে পারা কি একই ? লতার অঁাকড়ির মতো আমাদের মমত্ব সব কিছুকেই জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে, সেটা ভালোই হোক আর মন্দই হোক, তার পরে আর তাকে ছাড়তে পারি নে।” বিপ্রদাস বললে, “সেইজন্যেই তো সংসারে কাপুরুষের পূজার পূজারিনীর অভাব হয় না। তারা জানবার বেলা অপবিত্রকে অপবিত্র বলেই জানে, কিন্তু মানবার বেলায় তাকে পবিত্রের মতো করেই মানে ৷” কুমু বললে, “কী করব দাদা, সংসারকে দুই হাতে জড়িয়ে নিতে হবে বলেই আমাদের স্বষ্টি। তাই আমরা গাছকেও অঁাকড়ে ধরি, শুকনো কুটোকেও । গুরুকেও মানতে আমাদের যতক্ষণ লাগে, ভগুকে মানতেও ততক্ষণ । জাল যে আমাদের নিজের ভিতরেই। দুঃখ থেকে আমাদেরকে বাচাবে কে ? সেইজন্যেই