পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য 8●ぬ আবদ্ধ তাহ যেন কোনো কালে বিস্মৃত না হন। একদিন আমাদের বঙ্গভাষা কেবল একতারা যন্ত্রের মতো এক তারে বাধা ছিল, কেবল সহজ সুরে ধর্ম সংকীর্তন করিবার উপযোগী ছিল ; বঙ্কিম স্বহস্তে তাহাতে এক-একটি করিয়া তার চড়াইয়৷ আজ তাহাকে বীণাষন্ত্রে পরিণত করিয়া তুলিয়াছেন। পূর্বে যাহাতে কেবল স্থানীয় গ্রাম্য স্বর বাজিত তাহ আজ বিশ্বসভায় শুনাইবার উপযুক্ত ধ্রুবপদ অঙ্গের কলাবতী রাগিণী আলাপ করিবার যোগ্য হইয়া উঠিয়াছে। সেই তাহার স্বহস্তসম্পূর্ণ স্নেহপালিত ক্রোড়সঙ্গিনী বঙ্গভাষা আজ বঙ্কিমের জন্য অস্তরের সহিত রোদন করিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তিনি এই শোকোচ্ছাসের অতীত শাস্তিধামে দুষ্কর জীবনযজ্ঞের অবসানে নির্বিকার নিরাময় বিশ্রাম লাভ করিয়াছেন। মৃত্যুর পরে তাহার মুখে একটি কোমল প্রসন্নতা, একটি সর্বদু:খতাপহীন গভীর প্রশান্তি উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছিল– যেন জীবনের মধ্যাহ্নরৌদ্রদগ্ধ কঠিন সংসারতল হইতে মৃত্যু তাহাকে স্নেহস্থশীতল জননীক্রোড়ে তুলিয়া লইয়াছেন। আজ আমাদের বিলাপ-পরিতাপ তাহাকে স্পর্শ করিতেছে না, আমাদের ভক্তি-উপহার গ্রহণ করিবার জন্য সেই প্রতিভাজ্যোতির্ময় সৌম্য প্রসন্নমূর্তি এখানে উপস্থিত নাই। আমাদের এই শোক এই ভক্তি কেবল আমাদেরই কল্যাণের জন্য । বঙ্কিম সাহিত্যক্ষেত্রে যে আদর্শ স্থাপন করিয়া গিয়াছেন এই শোকে এই ভক্তিতে সেই আদর্শপ্রতিমা আমাদের অন্তরে উজ্জল এবং স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত হউক। প্রস্তরের মূর্তি স্থাপনের অর্থ এবং সামর্থ্য আমাদের যদি না থাকে, তবে একবার তাহার মহত্ত্ব সর্বতোভাবে মনের মধ্যে উপলব্ধি করিয়া তাহাকে আমাদের বঙ্গহৃদয়ের স্মরণস্তম্ভে স্থায়ী করিয়া রাখি । ইংরাজ এবং ইংরাজের আইন চিরস্থায়ী নহে ; রাজনৈতিক ধৰ্মনৈতিক সমাজনৈতিক মতামত সহস্রবার পরিবর্তিত হইতে পারে ; যে-সকল ঘটনা যে-সকল অনুষ্ঠান আজ সর্বপ্রধান বলিয়া বোধ হইতেছে এবং যাহার উন্মাদনার কোলাহলে সমাজের খ্যাতিহীন শব্দহীন কর্তব্যগুলিকে নগণ্য বলিয়া ধারণা হইতেছে, কণল তাহার স্মৃতিমাত্র চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট থাকিতে না পারে ; কিন্তু যিনি আমাদের মাতৃভাষাকে সর্বপ্রকার ভাবপ্রকাশের অন্তকুল করিয়া গিয়াছেন তিনি এই হতভাগ্য-দরিদ্র দেশকে একটি অমূল্য চিরসম্পদ দান করিয়াছেন। তিনি স্থায়ী জাতীয় উন্নতির একমাত্র মূল উপায় স্থাপন করিয়া গিয়াছেন। তিনিই আমাদের নিকট যথার্থ শোকের মধ্যে সাস্তুনা, অবনতির মধ্যে আশা, শ্রাস্তির মধ্যে উৎসাহ এবং দারিদ্র্যের শূন্ততার মধ্যে চিরসৌন্দর্যের অক্ষয় অাকর উদঘাটিত করিয়া দিয়াছেন। আমাদিগের মধ্যে যাহা-কিছু অমর এবং আমাদিগকে যাহা-কিছু অমর করিবে সেই-সকল মহাশক্তিকে ধারণ