পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8있이 +% রবীন্দ্র-রচনাবলী ইহার সহিত নিম্ন-উদ্ধৃত শ্লোকটি একসঙ্গে পাঠ করিলে প্রভেদ প্রতীয়মান হইবে। ‘অপসরী কিল্লরী দাড়াইয়ে তীরে ধরিয়ে ললিত করুণগতান বাজায়ে বাজায়ে বীণা ধীরে ধীরে গাহিছে অাদরে স্নেহের গান ।” 'অপ্সরী কিন্নরী’ যুক্ত অক্ষর লইয়া এখানে ছন্দ ভঙ্গ করিয়াছে। কবিও এই কারণে বঙ্গসুন্দরীতে যথাসাধ্য যুক্ত অক্ষর বর্জন করিয়া চলিয়াছেন। কিন্তু বাংলা যে-ছন্দে যুক্ত অক্ষরের স্থান হয় না সে ছন্দ আদরণীয় নহে। কারণ, ছন্দের ঝংকার এবং ধ্বনিবৈচিত্র্য, যুক্ত অক্ষরের উপরেই অধিক নির্ভর করে। একে বাংলা ছন্দে স্বরের দীর্ঘত্বস্বত নাই, তার উপরে যদি যুক্ত অক্ষর বাদ পড়ে তবে ছন্দ নিতান্তই অস্থিবিহীন সুললিত শব্দপিণ্ড হইয়া পড়ে। তাহা শীঘ্রই শ্রাস্তিজনক তন্দ্ৰাকর্ষক হইয় উঠে, এবং হৃদয়কে আঘাতপূর্বক ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতে পারে না! সংস্কৃত ছন্দে যে বিচিত্র সংগীত তরঙ্গিত হইতে থাকে তাহার প্রধান কারণ স্বরের দীর্ঘত্বস্বতা এবং যুক্ত অক্ষরের বাহুল্য। মাইকেল মধুসূদন ছন্দের এই নিগৃঢ় তত্ত্বটি অবগত ছিলেন সেইজন্য র্তাহার অমিত্রাক্ষরে এমন পরিপূর্ণ ধ্বনি এবং তরঙ্গিত গতি অনুভব করা যায়। আর্যদর্শনে বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গল’সংগীত, যখন প্রথম বাহির হইল, তখন ছন্দের প্রভেদ মুহূর্তেই প্রতীয়মান হইল। সারদামঙ্গলে’র ছন্দ নূতন নহে, তাহ প্রচলিত ত্রিপদী, কিন্তু কবি তাহ সংগীতে সৌন্দর্যে সিঞ্চিত করিয়া তুলিয়াছিলেন। ‘বঙ্গসুন্দরী’র ছন্দোলালিত্য অতুকরণ করা সহজ, এবং সেই মিষ্টত একবার অভ্যস্ত হইয়া গেলে তাহার বন্ধন ছেদন করা কঠিন কিন্তু ‘সারদামঙ্গলে’র গীতসৌন্দর্য অমুকরণসাধ্য নহে। ‘সারদামঙ্গল’ এক অপরূপ কাব্য। প্রথম যখন তাহার পরিচয় পাইলাম তখন তাহার ভাষায় ভাবে এবং সংগীতে নিরতিশয় মুগ্ধ হইতাম, অথচ তাহার আদ্যোপাস্ত একটা স্বসংলগ্ন অর্থ করিতে পারিতাম না। যেই একটু মনে হয় এইবার বুঝি কাব্যের মৰ্ম পাইলাম অমনি তাহ আকার পরিবর্তন করে। সূর্যাস্তকালের সুবর্ণ-মণ্ডিত মেঘমালার মতো ‘সারদামঙ্গলে’র সোনার শ্লোকগুলি বিবিধ রূপের আভাস দেয়, কিন্তু কোনে রূপকে স্থায়ীভাবে ধারণ করিয়া রাখে না— অথচ স্থদুর সৌন্দর্যস্বৰ্গ হইতে একটি অপূর্ব পূরবী রাগিণী প্রবাহিত হইয়া অন্তরাত্মাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে থাকে। এইজন্য সারদামঙ্গলের শ্রেষ্ঠতা অরসিক লোকের নিকট ভালোরূপে প্রমাণ করা