পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 & о রবীন্দ্র-রচনাবলী বলিতেছেন— ‘কুন্তী পুত্ৰগণ ও পুত্রবধুর দুঃখের বিবরণ স্মরণ করিয়া কৃষ্ণের নিকট অনেক কাদাকাটা করিলেন। উত্তরে কৃষ্ণ যাহা তাহাকে বলিলেন তাহ অমূল্য। যে-ব্যক্তি মচুন্যচরিত্রের সর্বপ্রদেশ সম্পূর্ণরূপে অবগত হইয়াছে সে ভিন্ন আর কেহই সে কথার অমূল্যত্ব বুঝিবে না। মূর্থের তো কথাই নাই। শ্ৰীকৃষ্ণ বলিতেছেন, “পাণ্ডবগণ নিদ্র। তন্দ্র ক্রোধ হর্ষ ক্ষুধা পিপাসা হিম রৌদ্র পরাজয় করিয়া বীরোচিত সুখে নিরত রহিয়াছেন । র্তাহারা ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ করিয়া বীরোচিত সুখে সন্তুষ্ট আছেন ; সেই মহাবলপরাক্রান্ত মহোৎসাহসম্পন্ন বীরগণ কদাচ অল্পে সন্তুষ্ট হয়েন না। বীর ব্যক্তিরা হয় অতিশয় ক্লেশ, না-হয় অত্যুৎকৃষ্ট সুখ সম্ভোগ করিয়া থাকেন ; আর ইন্দ্রিয়মুখাভিলাষী ব্যক্তিগণ মধ্যাবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকে ; কিন্তু উহা দুঃখের আকর ; রাজ্যলাভ বা বনবাস সুখের নিদান ।” বঙ্কিমবাৰু মহাভারত হইতে কৃষ্ণের যে উক্তি উদ্ভূত করিয়াছেন তাহ স্বগভীর ভাবগর্ত উপদেশে পূর্ণ। কিন্তু ইহা হইতে ঐতিহাসিক কৃষ্ণের চরিত্রনির্ণয়ের বিশেষ সাহায্য পাওয়া যায় এমন আমরা বিশ্বাস করি না। ইহাতে মহাভারতকার কবির মানবচরিত্রজ্ঞতা এবং হৃদয়ের উচ্চতা প্রকাশ করে। উদ্যোগপর্বের নবতিতম অধ্যায়ে কৃষ্ণের এই উক্তি বর্ণিত আছে ; ইহার প্রায় চল্লিশ অধ্যায় পরেই কুন্তীর মুখে বিদুলাসঞ্জয়সংবাদ-নামক একটি পুরাতন কাহিনী সন্নিবেশিত হইয়াছে ; তাহাতে তেজস্বিনী বিদুল তাহার যুদ্ধচেষ্টাবিমুখ পুত্র সঞ্জয়কে ক্ষত্রধর্মে উৎসাহিত করিবার জন্য যে কথাগুলি বলিয়াছেন কৃষ্ণের পূর্বোদধুত উক্তির সহিত তাহার কিছুমাত্র প্রভেদ নাই । বিদুল বলিতেছেন – ‘এখনও পুরুষোচিত চিন্তাভার বহন করে। অল্পদ্বারা পরিতৃপ্ত রাখিয়া অপরিমেয় আত্মাকে অনর্থক অবমানিত করিয়ে না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিম্নগাসকল যেমন অল্প জলেই পরিপূর্ণ হয় এবং মুষিকের অঞ্জলি যেমন অল্প দ্রব্যেই পূর্ণ হইয় উঠে সেইরূপ কাপুরুষেরাও অত্যপ্লমাত্রে পরিতৃপ্ত হওয়ায় সহজেই সন্তুষ্ট হইতে থাকে চিরকাল ধূমিত হওয়া অপেক্ষ মুহূর্তকাল জলিত হওয়াও শতগুণে শ্রেষ্ঠ।. ইহসংসারে প্রজ্ঞাবান পুরুষ অত্যন্ত্র বস্তুকে অপ্রিয় বোধ করেন ; অত্যন্ত্র বস্তু যাহার প্রিয় হয়, তাহার সেই অল্প বস্তুই নিশ্চয় অনিষ্টকর হইয়া থাকে।... যাহার। ফলের অনিত্যত্ব স্থির করিয়াও কর্মের অনুষ্ঠানে পরাজুখ না হয় তাহদের অভীষ্ট সিদ্ধ হইতেও পারে, না হইতেও পারে ; কিন্তু অনিশ্চিত বোধে যাহার একেবারেই অনুষ্ঠানে বিরত হয় তাহারা আর কস্মিন কালেও কৃতকার্য হইতে পারে না।’