পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 이 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আঁধারে তাহার ভবিষ্যৎ সমাচ্ছন্ন। মনের এই অবস্থায় আনন্দের ভিতরেও সে মনশ্চক্ষে দেখিত, যে কেহ তাহার সঙ্গে সম্বন্ধবিশিষ্ট সকলেরই জীবন অল্পবিস্তর দুঃখ যন্ত্রণাময় ।” পুরন্দরের এই অনাস্থষ্টি দুঃখভাবের গৃঢ় কারণ অনতিপরেই একটি ঘটনায় প্রকাশ পাইয়াছে। একদা তিনি এবং তাহার বন্ধু ব্রজ বেড়াইতে গিয়া দেখিলেন, গঙ্গাতীরে এক শালিকের কোটরের নিকট এক বিষধর সাপের সহিত শুকদম্পতির যুদ্ধ চলিতেছে। সেই পক্ষীদের নিরীহ শাবকগুলি এখনই সপের কবলস্থ হইবে মনে করিয়া পুরন্দরের চক্ষে এক ফোট জল আসিল । তাহার সঙ্গী ব্রজ অসাধারণ বালক নহে, এইজন্য সে এক ফোট জল না ফেলিয়া একখণ্ড লোষ্ট্র নিক্ষেপ করিল। তাহাতে অধিক কাজ হইল, আহত সর্প টা জলে পড়িয়া গেল। ব্রজ পুনশ্চ তাহার প্রতি লোষ্ট্রবর্ষণ করাতে পুরন্দর তাহ সহিতে পারিল না, বারণ করিল — সে ভাবিতেছিল খাদ্য-খাদকের অহি নকুলের যে বিষম বিদ্বেষ ভাব, ইহার জন্য কে দায়ী ? ভগবানের সংসার প্রেমময় না হইয়া কেন এমন হিংসাদ্বেষসংকুল হইল ? ' ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সকল বক্তৃতা শুনিয়া— ‘ব্রজ সহসা কোনো উত্তর দিতে পারিল না, কিন্তু তাহার প্রিয় সুহৃদের হৃদয়ে ব্যথা কোনখানে, বুঝিতে পারিল। বুঝিল, পুরনের দুঃখ ব্যক্তিগত নহে। টপিন তেল মালিশ করিলে যে-সকল ব্যথা সারে, অভাব মোচন হইলে যে-সকল দুঃখ দূর হয়, উপস্থিতক্ষেত্রে সেই সকল ব্যথা এবং সেই সকল দুঃখই ভালো। প্রচলিত প্রবাদে গরিবের ছেলের ঘোড়ারোগকে যেরূপ অনর্থের হেতু বলিয়াছে, বাংলাদেশীয় পল্লীর ছেলের এ-সকল বড়ো বড়ো ব্যথা এবং উচুদরের দুঃখও সেইরূপ সর্বনাশের কারণ । পুরন্দরের পিতা পুরন্দরকে লইয়া বাড়ি ফিরিবার সময় পথিমধ্যে অসন্তুষ্ট প্রজাগণ কর্তৃক নিহত হইলেন, তাহার স্ত্রী জগদ্ধাত্রী সহমৃতা হইলেন । পুরন্দর এই আঘাতে পীড়িত হইয়া বাড়ি গেলেন, সেখানে তাহার স্ত্রীর শুশ্রুষায় জীবন লাভ করিলেন, এবং প্তাহাদিগকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়া বিধবা নিস্তারিণী শ্ৰীক্ষেত্রে চলিয়া গেলেন। এইখানে গ্রন্থ শেষ হইল, কিন্তু গ্রন্থকার ক্ষান্ত হইলেন না, তিনি আবার শেষকে নিঃশেষ করিতে বসিলেন। অকস্মাৎ একদল যবন এবং যবনী মিলিয়া কালী ও ফুলকে চুরি করিয়া লইয়া গেল— কালী জলে ঝাপাইয় পড়িয়া মরিল— ফুল সিরাজউদৌলার অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল, পুরন্দর তাহাকে উদ্ধার করিতে গেল এবং উভয়ে ঘাতক হন্তে বিনষ্ট হইল।