পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য 8ఏని সিরাজদ্দৌলা শ্ৰীঅক্ষয়কুমার মৈত্রেয় -প্রণীত স্কুলে যাহাদিগকে ইতিহাস মুখস্থ করিতে হইয়াছে তাহদের সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে, ভারত-ইতিবৃত্তে ইংরাজ-শাসনকালের বিবরণ সর্বাপেক্ষা নীরস। তাহার একটা কারণ, এই বিবরণে মানবস্বভাবের লীলা পরিস্ফুট দেখা যায় না। গবর্নর আসিলেন, যুদ্ধ হইল, জয়পরাজয় হইল, পাচ বৎসর কাটিয়া গেল, গবর্নর চলিয়া গেলেন । অবখ্য ব্যাপারটা সত্যই এমন সম্পূর্ণ হৃদয়সম্পর্কশূন্ত কলের কাও নহে। ভারতশতরঞ্চমঞ্চে সাদা ও কালে ঘরে নানা পক্ষে যে-সকল বিচিত্র চাল চালিতেছিলেন, তাহার মধ্যে ভুলভ্রাস্তি-রাগদ্বেষ-লোভমোহের হাত ছিল না এমন নহে। কিন্তু রাজভক্তি ও পাঠ্যসমিতির প্রতি লক্ষ রাখিয়া লেখকদিগকে সংকীর্ণ সীমায় সভয়ে পদক্ষেপ করিতে হয়। সেইজন্য অন্তত বাংলায় রচিত ইতিহাসে ইংরাজশাসনের অধ্যায় অত্যন্ত শুষ্ক এবং শীর্ণ । আরও একটা কথা আছে । মোগল-পাঠানের সময় প্রত্যেক সম্রাট স্বতন্ত্র প্রভুরূপে স্বেচ্ছামতে রাজ্যশাসন করিতেন, সুতরাং তাহদের স্বাধীন ইচ্ছার আন্দোলনে ভারত-ইতিবৃত্তে পদে পদে রসবৈচিত্র্য তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু ইংরাজের ভারতবর্ষে ইংলণ্ডের রাজতন্ত্রের শাসন । তাহার মধ্যে হৃদয়ের লীলা অত্যন্ত গৌণ ব্যাপার। মানুষ নাই, রাজা নাই, কেবল একটা পলিসি অতি দীর্ঘ পথ দিয়া ডাক বসাইয়া চলিয়াছে, প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর তাহার বাহক বদল হয় মাত্র । সেই পলিসি কিরূপ স্বক্ষ জটিল সুদূরব্যাপী, এই মাকড়সাজালের স্বত্রগুলি জিব্রন্টার ইজিপ্ট এডেন প্রভৃতি দেশদেশান্তর হইতে লম্বমান হইয়া কেমন করিয়া ভারতবর্ষকে আপাদমস্তক ছাকিয়া ধরিয়াছে তাহার বিবরণ আমাদের পক্ষে কৌতুকাবহ সন্দেহ নাই— এবং সেই বিবরণ লায়াল সাহেবের ভারতসাম্রাজ্য গ্রন্থে যেমন সংক্ষেপে ও মনোরম আকারে বিবৃত হইয়াছে এমন আর-কোথাও দেখি নাই । কিন্তু এই বিবরণ মানববুদ্ধির নৈপুণ্যব্যঞ্জক ঐতিহাসিক যন্ত্রতত্ত্ব— তাহ পাঠকের চিরকৌতুকাবহ ঐতিহাসিক হৃদয়তত্ব নহে। পশ্চিমদেশের কল পূর্বদেশে কিরূপ পুতুলবাজি করাইতেছে তাহার মধ্যে কিঞ্চিৎ হাস্যরস কিঞ্চিৎ করুণরস এবং প্রভূত পরিমাণে বিস্ময়রস আছে, কিন্তু প্রত্যক্ষ হৃদয়ের সহিত হৃদয়ের সংঘর্ষে যে নাট্যরসভূয়িষ্ঠ সাহিত্যের উপাদান জন্মে ইহাতে তাহ স্বল্প ।