পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ○o রবীন্দ্র-রচনাবলী সমাজের প্রতি আমাদের যে-সকল কর্তব্য আছে তাহ পালন করিতে গেলেই কথঞ্চিং কৃত্রিমতা অবলম্বন করিতে হইবে। কারণ প্রত্যেকেই যদি নিজের রুচি ও হৃদয়াবেগের পরিমাণ অনুসারে স্বরচিত নিয়মে সামাজিক কর্তব্য পালন করে তবে আর উচ্ছঙ্খলতার সীমা থাকে না। সে স্থলে সর্বজনসম্মত একটা বাধা নিয়ম আশ্রয় করিতে হয়। যেমন স্বষ্টিকর্তা এই পৃথিবীকে কেবল বিশুদ্ধ ভাবরূপে রাখিয়া দেন নাই কিন্তু ভাবকে ভূরিপরিমাণ ধূলিরাশি দ্বারা ব্যক্ত করিয়াছেন, তেমনি, যাহা-কিছু কেবলমাত্র একাকীর নহে, যাহাকেই সর্বসাধারণের সেব্য এবং যোগ্য করিতে হইবে, তাহাকেই অনেকটা জড় কৃত্রিমতার দ্বারা দৃঢ় আকারবদ্ধ করিয়া লইতে হইবে। অরণ্যের অকৃত্রিম সৌন্দর্য সহৃদয় কবিগণ যতই ভালো বলুন, কৃত্রিম ইষ্টককাষ্ঠ রচিত মহানগর লোকসমাজের বাসের পক্ষে যে তদপেক্ষ অনেকাংশে উপযোগী তাহ অস্বীকার করিবার কারণ দেখি না। তরুর প্রত্যেক অংশ সজীব এবং স্বতোবর্ধিত, তাহার শোভা হৃদয়তৃপ্তিকর, তথাপি মহন্ত আপন সনাতন পূর্বপুরুষ শাখাযুগের প্রতি, ঈর্ষা প্রকাশ না করিয়৷ স্বহস্তরচিত অট্টালিকায় আশ্রয়গ্রহণপূর্বক যথার্থ মনুষ্যত্ব প্রকাশ করিয়াছে। যে-সকল ভাব প্রধানত নিজের, যেখানে বহিঃসমাজের কোনো প্রবেশাধিকার নাই, যেখানে মতুষ্যের হৃদয়ের স্বাধীনতা আছে, সেখানে কৃত্রিমতা দোষাবহ । কিন্তু মনুষ্যসমাজ এতই জটিল যে, কতটুকু আমার একাকীর এবং কতখানি বাহিরের সমাজের তাহার সীমানির্ণয় অনেক সময় দুরূহ হইয় পড়ে এবং অনেক সময় বাধ্য হইয়া আমার নিজস্ব অধিকারের মধ্য দিয়াও সমাজ-মুনিসিপ্যালিটির জন্য রাস্ত ছাড়িয়া দিতে হয়। একটা দৃষ্টাস্তের উল্লেখ করি। সহজেই মনে হইতে পারে, পিতৃশোক সস্তানের নিজের । সমাজের সে সম্বন্ধে আইন বাধিবার কোনো অধিকার নাই। সকল সন্তান সমান নহে, সকল সস্তানের শোক সমান নহে, এবং মনের প্রকৃতি অনুসারে শোকপ্রকাশের ভিন্ন উপায়ই স্বাভাবিক, তথাপি সমাজ আসিয়া বলে, তোমার শোক তোমারই থাক, অথবা না থাকে যদি সে সম্বন্ধেও কোনো প্রশ্নোত্তরের আবশ্যক নাই, কিন্তু শোকপ্রকাশের আমি যে বিধি করিয়া দিয়াছি, সৎ এবং অসৎ, গুরুশোকাতুর এবং স্বল্পশোকাতুর, সকলকেই তাহ পালন করিতে হইবে। পিতৃবিয়োগে শোক পাওয়া বা না পাওয়া লইয়া কথা নহে, সমাজ বলে, আমার নিকট শোকপ্রকাশ করিতে তুমি বাধ্য এবং তাহাও আমার নিয়মে করিতে হইবে। কেন করিতে হইবে ? কারণ, পিতার প্রতি ভক্তি সমাজের মঙ্গলের পক্ষে একান্ত