পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৭৪ Ա রবীন্দ্র-রচনাবলী মিনিটখানেক না। যাইতে যাইতে দিদিমাকে ধরিয়া পড়িলাম, “দিদিমা, একটা গল্প বলো।” দুই-চারিবার কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। মা বলিলেন, “রোস বাছা, খেলাটা আগে শেষ করি।” । আমি কহিলাম, “না, খেলা তুমি কাল শেষ কোরো, আজ দিদিমাকে গল্প বলতে বলো-না।” মা কাগজ ফেলিয়া দিয়া কহিলেন, “যাও খুড়ি, উহার সঙ্গে এখন কে পরিবে।” মনে মনে হয়তো ভাবিলেন, আমার তো কাল মাস্টার আসিবে না, আমি কালও খেলিতে পারিব। আমি দিদিমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া একেবারে মশারির মধ্যে বিছানার মধ্যে গিয়া উঠিলাম। প্রথমে খানিকটা পাশবালিশ জড়াইয়া, পা ষ্টুড়িয়া, নড়িয়া-চড়িয়া মনের আনন্দ সংবরণ করিতে গেল- তার পরে বলিলাম, “গল্প বলে ।” তখনো ঝুপ কুপ করিয়া বাহিরে বৃষ্টি পড়িতেছিল- দিদিমা মৃদুস্বরে আরম্ভ করিলেন- এক যে ছিল set r তাহার এক রানী। আঃ, বীচা গেল। সুয়াে এবং দুয়াে রানী শুনিলেই বুকটা কঁপিয়া উঠে— বুঝিতে পারি দুয়ো হতভাগিনীর বিপদের আর বিলম্ব নাই। পূর্ব হইতে মনে বিষম একটা উৎকণ্ঠা চাপিয়া থাকে। যখন শোনা গেল আর কোনো চিন্তার বিষয় নাই, কেবল রাজার পুত্রসন্তান হয় নাই বলিয়া রাজা ব্যাকুল হইয়া আছেন এবং দেবতার নিকট প্রার্থনা করিয়া কঠিন তপস্যা করিবার জন্য বনগমনে উদ্যত হইয়াছেন, তখন হাঁপ ছাড়িয়া বীচিলাম। পুত্রসন্তান না হইলে যে, দুঃখের কোনাে কারণ আছে তাহা আমি বুঝিতাম না ; আমি জানিতাম যদি কিছুর জন্য বনে যাইবার কখনাে আবশ্যক হয় সে কেবল মাস্টারের কােছ হইতে পালাইবার অভিপ্ৰায়ে । রানী এবং একটি বালিকা কন্যা ঘরে ফেলিয়া রাজা তপস্যা করিতে চলিয়া গেলেন। এক বৎসর দুই বৎসর করিয়া ক্ৰমে বারো বৎসর হইয়া যায়। তবু রাজার আর দেখা নাই। এদিকে রাজকন্যা ষোড়শী হইয়া উঠিয়াছে। বিবাহের বয়স উত্তীর্ণ হইয়া গেল কিন্তু রাজা ফিরিলেন না। মেয়ের মুখের দিকে চায়, আর রানীর মুখে অন্নজল রুচে না। “আহা, আমার এমন সোনার মেয়ে কি চিরকাল আইবুড়ো হইয়া থাকিবো। ওগো, আমি কী কপাল করিয়ছিলাম।” অবশেষে রানী রাজাকে অনেক অনুনয় করিয়া বলিয়া পাঠাইলেন, “আমি আর কিছু চাহি না, তুমি একদিন কেবল আমার ঘরে আসিয়া খাইয়া যাও।” রাজা বলিলেন, “আচ্ছা ।” রানী তো সেদিন বহু যত্নে চৌষটি ব্যঞ্জন স্বহন্তে রাধিলেন এবং সমস্ত সোনার থালে ও রুপার বাটিতে সাজাইয়া চন্দনকাষ্ঠের পিঁড়ি পাতিয়া দিলেন। রাজকন্যা চামর হাতে করিয়া দাড়াইলেন। রাজা আজ বারো বৎসর পরে অন্তঃপুরে ফিরিয়া আসিয়া খাইতে বসিলেন। রাজকন্যা রূপে আলো করিয়া দাড়াইয়া চামর করিতে লাগিলেন। মেয়ের মুখের দিকে চান আর রাজার খাওয়া হয় না। শেষে রানীর দিকে চাহিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “হঁ। গো রানী, এমন সোনার প্রতিমা লক্ষ্মীঠাকরুনটির মতো এ মেয়েটি কে গা । এ কাহাদের মেয়ে ।” রানী কপালে করাঘাত করিয়া কহিলেন, “হা আমার পোড়া কপাল। উহাকে চিনিতে পারিলে না ? ও যে তােমারই মেয়ে।” : রাজা বড়ো আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “আমার সেই সেদিনকার এতটুকু মেয়ে আজ এত বড়োটি হইয়াছে ?” রানী দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “তা আর হইবে না। বল কী, আজ বারো বৎসর হইয়া গেল।” রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, “মেয়ের বিবাহ দাও নাই ?” রানী কহিলেন, “তুমি ঘরে নাই উহার বিবাহ কে দেয়। আমি কি নিজে পাত্র খুঁজতে বাহির হইব ।” রাজা শুনিয়া হঠাৎ ভারি শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া বলিলেন, “রোসো, আমি কাল সকালে উঠিয়া রাজদ্বারে যাহার মুখ দেখিব তাঁহারই সহিত উহার বিবাহ দিয়া দিব।”