পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

९२२ রবীন্দ্র-রচনাবলী রাপ ও অরাপ জগৎ বলিয়া আমরা যাহা জানিতেহি সেই জানাটাকে আমাদের দেশে মায়া বলে। বস্তুত তাহার মধ্যে যে একটা মায়ার ভাব আছে তাহা কেবল তত্ত্বজ্ঞান বলে না, আধুনিক বিজ্ঞানও বলিয়া থাকে। কোনাে জিনিস বস্তুত স্থির নাই, তাহার সমস্ত অণু,পরমাণুনিয়ত কম্পমান অথচ জানিবার বেলায় এবং ব্যবহারকালে আমরা তাহাকে স্থির বলিয়াই জানিতেছি। নিবিড়তম বস্তুও জালের মতো ছিদ্রবিশিষ্ট অথচ জানিবার বেলায় তাহাকে আমরা আছিদ্র বলিয়াই জানি। স্ফটিক জিনিসটা যে কঠিন জিনিস তাহা দুৰ্যোধন একদিন ঠেকিয়া শিখিয়াছিলেন। অথচ আলোকের কাছে যেন সে জিনিসটা একেবারে নাইবলিলেই হয়। এদিকে যে মহাপ্রবল আকর্ষণ সূর্য হইতে পৃথিবী ও পৃথিবী হইতে সূর্যে প্রসারিত, যাহা লক্ষ কোটি হাতির বলকে পরাস্ত করে আমরা তাহার ভিতর দিয়া চলিতেছি কিন্তু মাকড়সার জালটুকুর মতেও তােহা আমাদের গায়ে ঠেকিতেছে না । আমাদের সম্বন্ধে যেটা আছে এবং যেটা নাই অক্তিত্বরাজ্যে যমজ ভাইয়ের মতো তাহারা হয়তো উভয়েই পরমাষ্ট্ৰীয় ; তাহদের মাঝখানে হয়তো একেবারেই ভেদ নাই। বস্তুমাত্রই একদিক থেকে দেখিতে গেলে বাষ্প- সেই বাষ্প ঘন হইয়া আছে বলিয়াই তাহাকে দৃঢ় আকারে বদ্ধ করিয়া প্রত্যক্ষ দেখি, কিন্তু উত্তাপের তাড়ায় তাহা আলগা হইয়া গেলেই মরীচিকার মতো তাহা ক্রমশই দৃষ্টির অগােচর হইবার উপক্ৰম করিতে থাকে। বস্তুত হিমালয় পর্বতের উপরকার মেঘের সহিত হিমালয়ের প্রভেদকে আমরা গুরুতর বলি বটে কিন্তু সেই গুরুতরত্ব ভাবিয়া দেখিলেই লঘু হইয়া পড়ে। মেঘ যেমন অদৃশ্য বাম্পের চেয়ে নিবিড়তর, হিমালয়ও সেইরূপ মেঘের চেয়ে নিবিড়তরা। তার পর কালের ভিতর দিয়া দেখো সমন্ত জিনিসই প্রবহমান। তাই আমাদের দেশে বিশ্বকে জগৎ বলে- সংসার বলে ; তাহা মুহুর্তকাল স্থির নাই, তাহা কেবলই চলিতেছে, সরিতেছে। যাহা কেবলই চলে, সরে, তাহার রূপ দেখি কী করিয়া ? রূপের মধ্যে তো একটা স্থিরত্ব আছে। যাহা চলিতেছে, তাহাকে, যেন চলিতেছে না, এমন ভাবে না দেখিলে আমরা দেখিতেই পাই না। লাটিম যখন দ্রুতবেগে ঘুরিতেছে তখন আমরা তাঁহাকে স্থির দেখি। মাটি ভেদ করিয়া যে অঙ্কুরটি বাহির হইয়াছে প্রতি নিমেষেই তাহার পরিবর্তন হইতেছে বলিয়াই তাহার পরিণতি ঘটে। কিন্তু যখন তাহার দিকে তাকাই সে কিছু মাত্র ব্যস্ততা দেখায় না ; যেন অনন্তকাল সে এইরকম অন্ধুর হইয়াই খুশি থাকিবে, যেন তাহার বাড়িয়া উঠিবার কোনো মতলবই নাই। আমরা তাহকে পরিবর্তনের ভাবে দেখি না, স্থিতির ভাবেই দেখি । এই পৃথিবীকে আমরা ক্ষুদ্রকালের মধ্যে বন্ধ করিয়া দেখিতেছি বলিয়াই ইহাকে ধ্রুব বলিয়া বর্ণনা করিতেছি- ধারণী আমাদের কাছে ধৈর্যের প্রতিমা। কিন্তু বৃহৎকালের মধ্যে ইহাকে দেখিতে গেলে ইহার ধ্রুবরূপ আর দেখি না। তখন ইহার বহুরূপী মূর্তি ক্রমেই ব্যাপ্ত হইতে হইতে এমন হইয়া আসে যে, আমাদের ধারণার অগোচর হইয়া যায়। আমরা বীজকে ক্ষুদ্রকালের মধ্যে বীজরাপে দেখিতেছি কিন্তু বৃহৎকালে তাহাকে দেখিতে গেলে তাহা গাছ হইয়া অরণ্য-পরম্পরার মধ্য দিয়া নানা বিচিত্ররূপে ধাবিত হইয়া পাথুরে কয়লার খনি হইয়া আগুনে পুড়িয়া ধোয়া হইয়া ছাই হইয়া ক্ৰমে যে কী হইয়া যায় তাহার আর উদ্দেশ পাওয়াই শক্ত । আমরা ক্ষণকালের মধ্যে বন্ধ করিয়া ধরিয়া যাহাকে জমাট করিয়া দেখি বস্তুত তাহার সেরূপ নাই কেননা সত্যই তাহা বন্ধ হইয়া নাই এবং ক্ষণকালেই তাহার শেষ নহে। আমরা দেখিবার জন্য জানিবার জন্য তাহাকে স্থির করিয়া স্বতন্ত্ৰ করিয়া তাহাকে যে নাম দিতেছি সে নাম তাহার চিরকালের সত্য নাম নহে। এইজন্যই আমরা যাহা কিছু দেখিতেছি জানিতেছি বলিয়া স্থির করিয়াছিতাহাকে মায়া বলা হইয়াছে। নাম ও রূপ যে শাশ্বত নহে। এ কথা আমাদের দেশের চাষীরাও বলিয়া থাকে। ] কিন্তু গতিকে এই যে স্থিতির মধ্য দিয়া আমরা জানি এই স্থিতির তত্ত্বটা তো আমাদের নিজের গড়া নহে । আমাদের গড়িবার ক্ষমতা কিসের ? অতএব, গতিই সত্য, স্থিতি সত্য নহে, এ কথা বলিলে চলিবে কেন ? বস্তুত সত্যকেই আমরা খুব বলিয়া থাকি, নিত্য বলিয়া থাকি। সমস্ত চঞ্চলতার মাঝখানে একটি স্থিতি আছে বলিয়া সেই বিধৃতিসূত্রে আমরা যাহা কিছু জানিতেছি নহিলে সে জানার বালাইমাত্র থাকিিত না- তাহাকে