পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ee8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমার সেই বন্ধু হয়তো বলিবেন, নির্জনতার কথা ছাড়িয়া দাও- কিন্তু সংসারে যেখানে চারিদিকেই ভালো-মন্দর তরঙ্গ কেবলই উঠা-পড়া করিতেছে সেইখনেই ঠিক সত্যভাবে ভালোকে চিনাইয়া দিবার সুযোগ পাওয়া যায়। বঁটার পরিচয় যেখানে নাই সেখানে কাটা নীচাইয়া চলিবার শিক্ষা হইবে কেমন করিয়া ? কঁটািবনের গোলাপটাই সত্যকার গোলাপ- আর বার বার অতি যত্নে চোলাই করিয়া লওয়া সাধুতার গােলাপি আতর একটা নবাবি জিনিস। হয়, সাধুতার এই নিষ্কণ্টক আতরটি কোন দোকানে মেলে তাঁহা নিশ্চয় জানি না। কিন্তু আমাদের আশ্রমে যে তাহার কারবার নাই তাহা নিজের দিকে তাকাইলেই বুঝিতে পারি। কাব্যে পুরাণে সর্বত্রই তপোবনের আদর্শািট অত্যুজ্জ্বল বর্ণনায় বিরাজ করে কিন্তু তবু সেই বৰ্ণনার ফাঁকে ফঁাকে বহুতর মুনীনাঞ্চ মতিভ্ৰমঃ ঘন ঘন উকি মারিতেছে। মানুষের আদর্শ যেমন সত্য, সেই আদর্শের ব্যাঘাতও তেমনি সত্য- যাহারা সেই ব্যাঘাতের ভিতর দিয়াই চোখ মেলিয়া আদর্শকে দেখিতে না পারে, চােখ বুজিয়া স্বপ্ন দেখা ছাড়া তাহদের আর গতি নাই । আমরা যে আশ্রমের কথা বলিতেছি, সেখানে লোকালয়ের অন্য বিভাগেরই মতো মন্দের জন্য সিংহদ্বার খোলাই আছে। শয়তানকে সেখানে সকল সময়ে সাপের মতো ছদ্মবেশে প্রবেশ করিতে হয় না- সে দিব্য ভদ্রলোকেরই মতো মাথা তুলিয়া যাতায়াত করে। সেখানে সংসারের নানা দাবি, বৈষয়িকতার নানা আড়ম্বর, প্রবৃত্তির নানা চাঞ্চল্য এবং অহং-পুরুষের নানা উদ্ধত মূর্তি সর্বদাই দেখিতে পাওয়া যায়। সাধারণ লোকালয়ে বরঞ্চ তাহারা তেমন করিয়া চোখেই পড়ে না- কারণ ভালোমন্দ সেখানে একপ্রকার। আপস করিয়া মিলিয়া-মিশিয়াই থাকে- এখানে তাহাদের মাঝখানে একটা বিচ্ছেদ আছে বলিয়াই মন্দটা এখানে খুব করিয়া দেখা দেয়। তাই যদি হইল। তবে আর হইল কী ? বন্ধুরা বলিবেন, যদি সেখানে জনতার চাপ লোকালয়ের চেয়ে কম না হইয়া বরঞ্চ বেশিই হয় এবং মন্দকেই যদি সেখান হইতে নিঃশেষে ছকিয়া ফেলিবার আশা না করিতে পার এবং যদি সেখানকার আশ্রমবাসীরা সংসারের সাধারণ লোকেরই মতো মাঝারি রকমেরই মানুষ হন তবে সেইপ্রকার স্থানই যে বালকবালিকাদের ধর্মশিক্ষার অনুকুল স্থান তাহা কেমন করিয়া বলিবে ? এ সম্বন্ধে আমার যাহা বক্তব্য তাহা এই- কবিকল্পনার দ্বারা আগাগোড়া মনোরম করিয়া যে একটা আকাশকুসুমখচিত আশ্রম গড়া যায় না। এ কথাটা আমাকে খুব স্পষ্ট করিয়াই বলিতে হইতেছে- কারণ আমার মতো লোকের মুখে কোনো প্রস্তাব শুনিলেই সেটাকে নিরতিশয় ভাবুকতা বলিয়া শ্রোতারা সন্দেহ করিতে পারেন। আশ্রম বলিতে আমি যে কোনো একটা অদ্ভুত অসম্ভব স্বল্পীসুলভ পদার্থের কল্পনা করিতেছি। তাহা নহে। সকল স্থূলদেহধারীর সঙ্গেই র্তাহার স্কুল দেহের ঐক্য আছে। এ কথা আমি বারংবার স্বীকার করিব। কেবল যেখানে তাহার সূক্ষ্ম জায়গাটি সেইখনেই তাহার স্বাতন্ত্ৰ্য। সে স্বাতন্ত্র্য সেইখানেই, যেখানে তাহার মাঝখানে একটি আদর্শ বিরাজ করিতেছে। সে আদর্শািট সাধারণ সংসারের আদর্শ নহে, সে আদর্শ আশ্রমের আদর্শ- তাহা বাসনার দিকে নয়, সাধনার দিকেই নিয়ত লক্ষ নির্দেশ করিতেছে। এই আশ্রম যদি পাকের মধ্যেও ফুটিয়া থাকে। তবু ভূমীর দিকে তাহার মুখ তুলিয়াছে, সে আপনাকে যদি বা ছাড়িতে না পারিয়া থাকে। তবু আপনাকে কেবলই ছাড়াইতে চাহিতেছে, সে যেখানে দাড়াইয়া আছে সেইখানেই তাহার পরিচয় নয়, সে যেখানে দৃষ্টি রাখিয়াছে সেইখনেই তাহার প্রকাশ। তাহার সকলের উর্ধের্ব যে সাধনার শিখটি জ্বলিতেছে তাহাঁই তাহার সর্বোচ্চ সত্য ৷ ‘ · কিন্তু কেনই বা বড়ো কথাটাকে গোপন করিব ? কেনই বা কেবল কেজো লোকদের মন জোগাইবার জন্য ভিতরকার আসল রসটিকে আড়াল করিয়া রাখিব ? এই প্রবন্ধ শেষ করিবার পূর্বে আমি অসংকোচে বলিব, আশ্রম বলিতেই আমাদের মনের সামনে যে ছবিটি জাগে যে ভাবটি ভরিয়া উঠে তাহা আমাদের সমস্ত হৃদয়কে হরণ করে। তাহার কারণ, শুদ্ধমত্র এ নহে যে তাহা আমাদের জাতির অনেক যুগের ধ্যানের ধন, সাধনার সৃষ্টি- তাহার গভীর কারণ এই আমাদের সমস্তের সঙ্গে তাহার ভারি একটি সংগতি দেখিতে পাই, এইজন্যই তাঁহাকে এমন সত্য এমন সুন্দর বলিয়া ঠেকে। বিধাতার কাছে আমরা যে দান পাইয়ারি তাহাকে অস্বীকার করিব কেমন করিয়া ? আমরা তো ঘন মেঘের কালিমলিপ্ত আকাশের নীচে জন্মগ্রহণকর্দি