পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(brО রবীন্দ্র-রচনাবলী বিশ্বামিত্রই রামচন্দ্রকে জনকের গৃহে লইয়া গিয়াছিলেন এবং এই বিশ্বামিত্রের নেতৃত্বেই রামচন্দ্ৰ জনকের ভূকর্ষণজাত কন্যাকে ধৰ্মপত্নীরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন।এই সমস্ত ইতিহাসকে ঘটনামূলক বলিয়া গণ করিবার কোনাে প্রয়োজন নাই, আমি ইহাকে ভাবমূলক বলিয়া মনে করি। ইহার মধ্যে হয়তো তথ্য খুঁজলে ঠকিব কিন্তু সত্য খুজিলে পাওয়া যাইবে। মূল কথা এই, জনক ক্ষত্রিয় রাজার আদর্শ ছিলেন। ব্রহ্মবিদ্যা তাহাকে আশ্রয় করিয়া বিকাশলাভ করিয়াছিল। এ বিদ্যা কেবলমাত্র তঁহার জ্ঞানের বিষয় ছিল না ; এ বিদ্যা তাহার সমস্ত জীবনে রূপ গ্ৰহণ করিয়াছিলেন ইতিহাসে তাহা কীর্তিত হইয়াছে। চরমতম জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তির সঙ্গে প্রাত্যহিক জীবনের ছোটাে বড়ো সমস্ত কর্মের আশ্চর্য যোগসাধন ইহাই ভারতবর্ষের ক্ষত্রিয়দের সর্বোচ্চ কীর্তি। আমাদের দেশে র্যাহারা ক্ষত্রিয়ের অগ্রণী ছিলেন তাহারা ত্যাগকেই ভোগের পরিণাম করিয়া কর্মকে মুক্তিলাভের শ্ৰেষ্ঠ উপায় বলিয়া প্রচার করিয়াছিলেন। x এই জনক এক দিকে ব্ৰহ্মজ্ঞানের অনুশীলন, আর-এক দিকে স্বহস্তে হলচালন করিয়াছিলেন। ইহা হইতেই জানিতে পারি কৃষিবিস্তারের দ্বারা আর্যসভ্যতা বিস্তার করা ক্ষত্রিয়দের একটি ব্ৰতের মধ্যে ছিল। একদিন পশুপালন আৰ্যদের বিশেষ উপজীবিকা ছিল। এই ধেনুই অরণ্যাশ্রমবাসী ব্ৰাহ্মণদের প্রধান সম্পদ বলিয়া গণ্য হইত। বনভূমিতে গোচারণ সহজ ; তপোবনে যাহারা শিষ্যরূপে উপনীত হইত গুরুর গোপালনে নিযুক্ত থাকা তাহদের প্রধান কাজ ছিল। অবশেষে একদিন রণজয়ী ক্ষত্রিয়েরা আর্যবর্ত হইতে অরণ্যবাধা অপসারিত করিয়া পশুসম্পদের স্থলে কৃষিসম্পদকে প্রবল করিয়া তুলিলেন। আমেরিকায় যুরোপীয় ঔপনিবেশিকগণ যখন অরণ্যের উচ্ছেদ করিয়া কৃষিবিস্তারের ক্ষেত্র প্রশস্ত করিতেছিলেন তখন যেমন মৃগয়াজীবী আরণ্যকগণ পদে পদে তাহাদিগকে বাধা দিতেছিল- ভারতবর্ষেও সেরূপ আরণ্যকদের সহিত কৃষকদের বিরোধে কৃষিব্যাপার কেবলই বিয়ুসংকুল হইয়া উঠিয়ছিল। যাহারা অরণ্যের মধ্যে কৃষিক্ষেত্র উন্মুক্ত করিতে যাইবেন তঁহাদের কােজ সহজ ছিল না। জনক মিথিলার রাজা ছিলেন- ইহা হইতে জানা যায় আর্যাবর্তের পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত আৰ্য উপনিবেশ আপনার সীমায় আসিয়া ঠেকিয়াছিল। তখন দুৰ্গম বিন্ধ্যাচলের দক্ষিণভাগে অরণ্য অক্ষত ছিল এবং দ্রাবিড়সভ্যতা সেই দিকেই প্রবল হইয়া আর্যদের প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠিয়াছিল। রাবণ বীরপরাক্রমে ইন্দ্র প্রভৃতি বেদের দেবতাকে পরাস্ত করিয়া আর্যদের যজ্ঞের বিঘ্ন ঘটাইয়া নিজের দেবতা শিবকে জয়ী করিয়াছিলেন। যুদ্ধজয়ে স্বকীয় দলের দেবতার প্রভাব প্রকাশ পায় পৃথিবীতে সকল সমাজেরই বিশেষ অবস্থায় এই বিশ্বাস দৃঢ় থাকে- কোনো পক্ষের পরাভাবে সে পক্ষের দেবতারই পরাভব গণ্য হয় । রাবণ আৰ্যদেবতা দিগকে পরাস্ত করিয়াছিলেন এই যে লোকশ্রুতি আমাদের দেশে প্রচলিত আছে ইহার অর্থই এই যে, তাহার রাজত্বকালে তিনি বৈদিক দেবতার উপাসকদিগকে বারংবার পরাভূত করিয়াছিলেন। । এমন অবস্থায় সেই শিবের হরধনু ভাঙিবে, কে একদিন এই এক প্রশ্ন আৰ্যসমাজে উঠিয়াছিল। শিবোপাসকদের প্রভাবকে নিরন্ত করিয়া যিনি দক্ষিণখণ্ডে আর্যদের কৃষিবিদ্যা ও ব্রহ্মবিদ্যাকে বহন করিয়া লইয়া যাইতে পরিবেন। তিনিই যথার্থভাবে ক্ষত্ৰিয়ের আদর্শ জনকরাজার অমানুষিক মানসকন্যার সহিত পরিণীত হইবেন । বিশ্বামিত্র রামচন্দ্ৰকে সেই হরধনু ভঙ্গ করিবার দুঃসাধ্য পরীক্ষায় লইয়া গিয়াছিলেন। রাম যখন বনের মধ্যে গিয়া কোনো কোনো প্রবল দুর্ধর্ষ শৈববীরকে নিহত করিলেন তখনই তিনি হরধনু ভঙ্গের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেন এবং তখনই তিনি সীতাকে অর্থাৎ হালচালনরেখাকে বহন করিয়া লইবার অধিকারী হইতে পারিলেন। তখনকার অনেক বীর রাজাই এই সীতাকে গ্ৰহণ করিবার জন্য উদ্যত হইয়াছিলেন। কিন্তু র্তাহারা হরধনু ভাঙিতে পারেন নাই, এইজন্য রাজর্ষিজনকের কন্যাকে লাভ করিবার গীেরব হইতে র্তাহারা বঞ্চিত হইয়া ফিরিয়া গিয়াছেন। কিন্তু এই দুঃসাধ্য ব্ৰতের অধিকারী কে হইবেন, ক্ষত্রিয় তপস্বিগণ সেই সন্ধান হইতে বিরত হন নাই। একদা বিশ্বামিত্রের সেই সন্ধান রামচন্দ্রের মধ্যে আসিয়া সার্থক হইল । বিশ্বামিত্রের সঙ্গে রামচন্দ্র যখন বাহির হইলেন তখন তরুণ বয়সেই তিনি তাহার জীবনের তিনটি বড়ো বড়ো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। প্রথম, তিনি শৈব রাক্ষসদিগকে পরান্ত করিয়া হরধনু ভঙ্গ